ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

নিলা উদ্ধার হলেও মিম নিখোঁজ

এস এম আববাস, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯২৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৩, ২০১৫
নিলা উদ্ধার হলেও মিম নিখোঁজ মিম

ঢাকা: মিমের বয়স বারো পেরিয়ে গেছে। মেয়ে বড় হচ্ছে, অন্যের বাড়িতে আর কাজে রাখা ঠিক হবেনা।

দু’বেলা না হোক, একবেলা খাইয়ে হলেও নিজের কাছে রাখতে হবে।
 
মা আইরিন বেগম তার শিশু কন্যা মিমকে ফিরিয়ে আনার এমন ভাবনায় ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই ছুটে যান কাকরাইলের ৮২/১ ইস্টার্ন পার্কের গোলাম মোস্তফার বাসায়। তবে ফিরিয়ে আনাতো দূরের কথা দেখাও পাননি দু’টি সন্তানের।
 
এটি গত ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকের কথা। দিন-সময় নির্দিষ্ট করে বলতে পারছিলেন না আইরিন। তবে থানায় দায়ের করা অভিযোগ থেকে তা জানতে অসুবিধে হয়নি।
 
রাজধানীর আদাবর এলাকার চল্লিশোর্ধ্ব গৃহকর্মী  আইরিন তার মেয়ে মিমের নিখোঁজ হওয়ার বর্ণনা শুরু করেন এভাবে। শুধু তাই নয় আরেক মেয়ে শিশু নিলাকে এলাকাবাসী ও মানবাধিকার কর্মীর সহায়তায় উদ্ধারের কথাও জানান তিনি।
 
আইরিন বাংলানিউজকে জানান, বড় মেয়ে লিজা (২২), মেঝ মেয়ে মিম (১২), তৃতীয় মেয়ে নিলা (১০) এবং ছোট মেয়ে ৭ বছরের লিমা, এই  চার মেয়ে আর একমাত্র পুত্র সন্তান আরিফকে (২০) সঙ্গে নিয়ে আইরিন স্বামীর সঙ্গে গাইবান্ধা থেকে ঢাকায় আসেন কয়েক বছর আগে। স্বামী-স্ত্রী কাজ করে যদি দু’বেলা খাবার জোটে সে জন্যই অজানা নগর জীবনে ছুটে আসা তাদের।
 
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নবদা হাউজিংয়ের এক কোণে ঠাঁই জোটে ভাড়া বাসায়। স্বামী মনজুর রহমান রিকশা চালিয়ে আর আইরিন অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে যে টাকা আয় করেন তা দিয়ে সাত সদস্যের সংসারে কোনো রকমে বেঁচে থাকার উপায় তৈরি হয়। কিন্তু অভাবের সংসারে স্বামী মনজুর রহমান বেশিদিন থাকেননি। স্ত্রী-সন্তান রেখেই চলে যান মনজুর।
 
এরপর অভাবের সঙ্গে লড়াই করেই বেঁচে থাকার চেষ্টা করেন এই গৃহকর্মী। চার মেয়ে এবং এক ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে আদাবরে আরেক ভাড়া বাসায় উঠেন আইরিন। কিন্তু অভাব তার পিছু ছাড়েনি।
 
চায়না নামের এক প্রতিবেশী আইরিনকে পরামর্শ দেন মেয়েদের বাড়িতে বসিয়ে না রেখে কোথাও কাজে দিলে কিছু উপার্জন হবে। সংসারে সচ্ছলতা আসবে। তার পরামর্শে সংসারে সচ্ছলতা ফেরাতে কাকরাইলের ৮২/১ ইস্টার্ন পার্কের পঞ্চম তলায় মো. গোলাম মোস্তফার বাসায় মিমকে কাজে রাখেন মা আইরিন।
 
আইরিনের ভাড়া বাসায় গোলাম মোস্তফা এসে দুই হাজার টাকা বেতন মিটিয়ে নিয়ে যান মিমকে। কিছুদিন পরে এসে মিমের ছোট বোন নিলাকেও এক হাজার টাকা বেতন মিটিয়ে নিয়ে যান তিনি। ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বার বার প্রশ্ন করেন মেয়েকে ফিরে পাবো তো?
 
আইরিন জানান, কিছুদিন বেতন ঠিকঠাক মতো দিলেও পরে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন গোলাম মোস্তফা। মিম ও নিলার সঙ্গে দেখা করতেও দেননি ওই ব্যক্তি।   একপর্যায়ে মিমকে তার কাছে নিয়ে আসার জন্য ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে কাকরাইলে গোলাম মোস্তফার বাড়ি যান আইরিন। কিন্তু দেখা না করেই চলে আসতে বাধ্য হন। কাকরাইলের ওই বাসা থেকে গোলাম মোস্তফা জানিয়ে দেন পরদিন সকালে বাসায় গিয়ে দেখা করবেন এবং মিমের বিষয়ে কথা বলবেন।
 
পরদিন ৭ ফেব্রুয়ারি সকালে আইরিনের বাসায় পৌঁছে খোঁজ-খবর নেন গোলাম মোস্তফা। কিন্তু মিমকে সঙ্গে নিয়ে আসেননি। ব্যাকুল হয়ে মা আইরিন ‘মিম কোথায়’ জানতে চান। মিমের ব্যাপারে কোনো কথা না বলে চলে যাওয়ার সময় গোলাম মোস্তফা তাকে জানান বিকেলে তিনি আবার আসবেন।
 
ওইদিন বিকেলে ঠিকই আইরিনের বাসায় ফিরে গিয়েছিলেন গোলাম মোস্তফা। তখনও মিমকে সঙ্গে আনেননি। মিমের মায়ের হাতে এক হাজার টাকা দিয়ে গোলাম মোস্তফা বলে আসেন ‘তোর মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।   টাকা দিয়ে গেলাম খুঁজে বের কর। আমিও খুঁজে বের করার চেষ্টা করি’।
 
রাত পার করেই মা আইরিন পরদিন ৮ ফেব্রুয়ারি গোলাম মোস্তফার বাসায় কাকরাইলে যান। অনেক কষ্টে দারোয়ানকে ম্যানেজ করে বাসায় ঢুকে মিমকে ফেরত চান আইরিন। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। আইরিনকে হুমকি-ধমকি দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। কোনো উপায় না দেখে থানায় গিয়ে মামলার চেষ্টা করেন আইরিন।
 
ছোট মেয়েসহ বন্দিদশা থেকে দুই মেয়েকে ফেরতের দাবিতে রমনা থানায় অভিযোগ করেন আইরিন। প্রথমে মামলা করতে ব্যর্থ হলেও বাংলাদেশ আওয়ামী বাস্তুহারা লীগের রাহিমা ইসলাম এবং ব্লাস্ট ও বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির সহায়তায় থানা তার অভিযোগটি ১০ ফেব্রুয়ারি জিডি আকারে গ্রহণ করে।
 
এরপর পুলিশ ছোট মেয়ে নিলাকে উদ্ধার করে গোলাম মোস্তফার কাছ থেকে। তবে বড় মেয়ে মিমের কোনো খোঁজ পায়নি পুলিশ। পুলিশের কাছেও হারিয়ে গেছে এমন কথা বলেই পার পেয়ে যান গোলাম মোস্তফা।
 
এ বিষয়ে রমনা থানার সাব-ইন্সপেক্টর মনিরুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, মানবাধিকার সংগঠনসহ গোলাম মোস্তফার বাসায় তল্লাশি চালালে গোলাম মোস্তাফা তার এক আত্মীয়ের বাসা থেকে এনে দেন শিশু নিলাকে। কিন্তু গোলাম মোস্তফার বাসায় রাখা মিমকে ফেরত পাওয়া যায়নি।
 
মনিরুজ্জামান বলেন, ভোরে কাউকে কিছু না বলে মিম বাসা থেকে বের হয়ে গেছে বলে গোলাম মোস্তফা পুলিশ ও মানবাধিকার কর্মীদের জানিয়েছেন।
 
কোনো ক্লু পেলে পুলিশ তাকে উদ্ধার করবে বলে জানান রমনা থানার ওই পুলিশ কর্মকর্তা।  
 
এর পর থেকে ৯ মাসেও কোনো খোঁজ মেলেনি মিমের। গৃহকর্মী আইরিনও মেয়েকে ফেরত পাওয়ার আশায় পুলিশ, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের কাছে ছুটে চলেছেন। বাংলানিউজকে আইরিন বলেন, গোলাম মোস্তফাই মিমকে নিজ দখলে রাখতে লুকিয়ে রেখেছেন।
 
বাংলাদেশ সময় : ০৯২৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৩, ২০১৪
এসএমএ/আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।