গাইবান্ধা রেল স্টেশন থেকে: ঘড়ির কাঁটা দুপুর সোয়া দুইটা ছুঁই ছুঁই করছে। পুরো স্টেশনে যাত্রী গিজ গিজ করছে (রংপুরমুখী)।
সকাল থেকে এতোক্ষণে তিনটি ট্রেন রংপুর অভিমুখে ছেড়ে যাওয়ার কথা। এজন্য অনেকে শুক্রবার (১৩ নভেম্বর) সকাল ৮টা থেকে ট্রেনের জন্য অপেক্ষায় আছেন। কিন্তু কোনো ট্রেনের দেখা পাননি। বেলা বাড়ার সঙ্গে তাদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে।
ট্রেনের অপেক্ষায় থাকা পাওটানা ফাজিল মাদরাসার সহকারী শিক্ষিকা শরিফা বেগম জানালেন, তিনি যাবেন পীরগাছা স্টেশনে। গাইবান্ধা স্টেশনে এসেছেন সকাল ৯টায়। কিন্তু কোনো ট্রেন পাননি। কখন ট্রেন আসবে, সেটা রেলওয়ের কর্তারাও তাকে বলতে পারছে না।
কর্তব্যরত স্টেশন মাস্টার (গ্রেড-৮) বীরেন্দ্র নাথ দাসের চেম্বারে ঢু মারতেই অবাক হতে হলো। বাইরে যাত্রীদের উদ্বেগের লেশমাত্র নেই তার মধ্যে। ডান হাতে দুই আঙ্গুলে পানের বোটার মাথায় শোভা পাচ্ছে এক চিলতে চুন। আয়েশি ভঙ্গিতে পান চিবোচ্ছেন। মুখ ভর্তি পানের রস ঠেকাতে বিশেষ ভঙ্গিতে কথা বলছিলেন।
পীরগাছায় যাওয়ার ট্রেন কখন পাওয়া যাবে, এমন প্রশ্ন করতে বললেন, আমিই জানতে পারছি না, আপনাকে কী বলবো। বেশি তাড়া থাকলে বাসে চলে যেতে পারেন। ট্রেন কখন আসবে বলতে পারছি না।
আর বাসে যেতে দুই ঘণ্টার মতো লাগবে তা-ও বাতলে দিলেন তিনি।
গাইবান্ধা থেকে পীরগাছার ট্রেনের দূরত্ব ৪১ কিলোমিটার। আর বাসে যেতে হলে পলাশবাড়ী, রংপর জেলা সদর ঘুরে যেতে পথ পাড়ি দিতে হয় ১০৫ কিলোমিটার। যে কারণে অনেক দুর্ভোগ হলেও রেলেই একমাত্র ভরসা চৌধুরানী, পীরগাছা, কাউনিয়াগামী যাত্রীদের।
সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে ট্রেনের বিলম্বের হেতু জানতে চাইলে বীরেন্দ্র নাথ দাস বলেন, শুনেছি নশরতপুরে ট্রেন লাইনচ্যুত হয়েছিলো। এখন ঠিক হয়েছে।
কখন ট্রেন লাইনচ্যুত হয়েছে, জানতে চাইলে বলেন, এখান থেকে সে তথ্য দিতে পারবো না।
স্টেশনে টানানো নোটিশ বোর্ড অনুযায়ী সকাল ৯টা থেকে পদ্মরাগ, উত্তরবঙ্গ মেইল (সেভেন আপন), দোলনচাপা এক্সপ্রেস গাইবান্ধা স্টেশনে যাত্রী নিয়ে পীরগাছামুখী যাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু এদিন একটিরও দেখা মেলেনি।
মানিক লাল দাস এই রুটের নিয়মিত যাত্রী। তিনিও সকাল ১০টা থেকে স্টেশনে অপেক্ষা করছেন। বসার জন্য পাতানো (কংক্রিটের) বেঞ্চগুলো অনেক আগেই ভরপুর হয়ে গেছে।
কালী চরণ দাস নামের মাঝবয়সী এক যাত্রী ১১টা থেকে অপেক্ষা করছেন স্টেশনে। যাবেন কাউনিয়ায়, তার মেয়ের বাড়িতে। দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে প্লাটফর্মেই মাথায় হাত ঠেস দিয়ে বসে আছেন।
মানিক লাল-কালী চরণরা জানেন না, কখন দেখা মিলবে ট্রেনের, আর কখন যাবেন গন্তব্যে।
কেবল শুক্রবারের নয়, গাইবান্ধা স্টেশনের লোকাল ট্রেনগুলোর নিয়মিত চিত্র এটি। কোনদিন কোন ট্রেনটি আসবে না, তারও কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই।
রামসাগর এক্সপ্রেস দুই বছর ধরে বন্ধ। এই ট্রেনটি সকাল ৬টায় বোনারপাড়া থেকে দিনাজপুরের উদ্দেশে ছেড়ে যেতো। আর দুপুর দু’টায় দিনাজপুর থেকে বোনারপাড়ায় ফিরতো। দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ড এলাকায় যাতায়াতকারীরা সহজে এই ট্রেন ধরে দিনে দিনে কাজ করে বাসায় ফিরতে পারতেন। কিন্তু অদৃশ্য কারণে ট্রেনটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। যদিও নোটিশ বোর্ডে এখনো ঝুলছে ট্রেনটির নাম।
এ বিষয়ে বীরেন্দ্র নাথ দাস জানান, অনিবার্য কারণের কথা বলে ট্রেনটি বন্ধ করা হয়েছে। আমরা এর বেশি কিছু জানি না।
ট্রেনটিতে অনেক যাত্রী আসা-যাওয়া করতো বলেও জানান তিনি।
বীরেন্দ্র নাথ দাসের যাত্রীদের নিয়ে উদ্বেগ না থাকলেও সুইপার ডেকে স্টেশন পরিষ্কার করতে তৎপর দেখা গেছে। ঠিকমতো পরিষ্কার হচ্ছে কি-না দাঁড়িয়ে থেকে সে নির্দেশনা দিচ্ছিলেন তিনি।
কাছে যেতেই বললেন, দেখেন এতোবড় একটি স্টেশনে মাত্র একজন সুইপার। একজন সুইপার কতটুকু কাজ করতে পারবে বলেন। অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী তিনজন সুইপার থাকার কথা ছিল। দুইজন অবসরে গেছে, সেই পদগুলো আর পূরণ করা হয়নি। সম্ভব হলে ঢাকায় গিয়ে স্যারদের কাছে বিষয়টি তুলে ধরলে আমরা কৃতজ্ঞ হবো।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৩, ২০১৫
এসআই/এইচএ/