ঢাকা: মনে করা হতো কলকাতার কলেজ স্ট্রিট। সেখানে যেভাবে সাহিত্য সংস্কৃতি আর বই এর সম্ভার, তেমনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে আজিজ সুপার মার্কেট আরেকটি বইপাড়া।
এখন বই মার্কেট মনে করে কেউ এখানে এলে হতাশ হবেন। তার কারণ, বইয়ের দোকান খুঁজে পাওয়া ভার। নিচ তলায় এখনো কিছু বইয়ের দোকান আছে বটে, কিন্তু দ্বিতীয়-তৃতীয় সব তলা জুড়ে বাহারি পোশাক বাজার। এখন পোশাকের নানা রঙ্গ আর ডিজাইনের খোঁজেই এখানে আসছে লোকজন।
ঢাকার অনেকের চোখের সামনেই যেন এই বইপাড়া হারিয়ে গেলো।
বইপাড়ার সেকালের গল্প শুনতে সেই আড্ডাবাজদের খোঁজ করি। তার একজন সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল। আজিজ সুপার মার্কেটের শুরুর দিকে লেখালেখি, প্রকাশনা আর সম্পাদনার আড্ডার শুরুর দিকের তিনিও একজন।
কানাডার টরন্টো থেকে বাংলানিউজের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলে জানান, আজিজ মার্কেট শুরু ও তার আগের গল্প।
পিজি হাসপাতালের একপাশে একটা ছ্যাপড়া ঘরে আড্ডা দিতেন তারা। সেখানে জমা হতেন একের পর এক কবি সাহিত্যিকও।
তখন আজিজ সুপার মার্কেট মাত্র গড়ে উঠছে। ১৯৮৭ সালের দিকে শহিদুল ইসলাম বিজু ওই মার্কেটে’র এক কোণায় পাঠক সমাবেশ নামে বইয়ের দোকান দেন। এরপর থেকেই মার্কেটে বইয়ের যাত্রা শুরু। একের পর এক বইয়ের দোকান, প্রকাশনী খুলতে থাকে।
তার সঙ্গে কম্পিউটার, প্রিন্ট- এসব কিছুও এখানে আসতে থাকে। অনেক প্রকাশনী ধীরে ধীরে জমতে থাকে আজিজ সুপার মার্কেটে।
দুলাল বলেন, একটা সময় এতো জমে উঠেছিলো যে, এখানে আর্ট গ্যালারি হওয়ার কথা ছিলো। নাটকের রিহার্সেল এখানেই হতো।
নাটক, কবিতা, গান, সাতিত্য সব কিছুর একটা কেন্দ্র হয়ে উঠে আজিজ মার্কেট। যেখানে জমতো সব আড্ডা। অনেক শিল্পী, লেখক, সাহিত্যিক এখান থেকে উঠে আসেন। রিফাত ও মাহমুদুজ্জামান বাবুর মত শিল্পীর জন্ম এখান থেকেই। সেই সময়ের যত বড় কবি সাহিত্যিক ছিলেন তারা ঘুরে ফিরে আসতেন আজিজ মার্কেটে। সচিবরা এখানে বই কিনতে আসতেন।
অর্থনীতিবিদ আকবর আলী খান, আবুল মাল আবদুল মুহিত, আল মাহমুদ, শামসুর রাহমান সবাই আসতেন এখানে। আজকের মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও আজিজে আসতেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার কাছে হওয়ায় সেখানকার অনেক কিছু তখন এখানে পাওয়া যেত। শিক্ষার্থীরা এখানে এসব কিনতে আসতো।
লেখকদের মধ্যে আহমদ ছফার অফিস ছিলো দু’তলায়। সেই সুবাদে সেখানে বড় বড় সব সাহিত্যিক লেখকের আনাগোনা ছিলো।
নব্বইয়ের দশকে তার পাঠশালার ও স্বরব্যঞ্জনের অফিস ঘিরেও বেশ আড্ডা জমতো। কাপের পর কাপ চায়ে আড্ডা দিতেন লেখক সাহিত্যিকরা। সেখানে আসতেন শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদের মত কবিরা।
সে সময়কার বন্ধনটাও অন্যরকম ছিলো, ছিলো ভালোবাসা।
এছাড়াও অনেকগুলো লিটল ম্যাগাজিনের প্রতিষ্ঠান ছিলো আজিজ মার্কেটৈ। লুৎফর রহমান রিটনকে কেন্দ্র করে আরও অনেকে আসতেন।
দুলাল জানান, গত দশকের শেষদিকে তিন তলায় শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীকে নিয়ে এসে মঙ্গল প্রদীপ জ্বেলে নিত্য উপহার প্রথম কাপড়ের দোকান খোলে। তবে তারা সাহিত্যিক চেতনা ও দেশজ ঐহিত্য নিয়ে পোশাকের দোকান দেয়।
তারপর থেকে বুটিকের দোকানে ভরে যেতে থাকে মার্কেট।
আজিজ সুপার মার্কেটের এই গল্পের দৃশ্যগুলো এখন অচেনা। কত শত বড় কবি সাহিত্যিকদের আড্ডাস্থল শুধুই যেন স্মৃতিচারণ।
এরপরও যে গুটিকয়েক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান এই মার্কেটে আছে, তার কোনোটি পোশাকের দোকানের পেছনে, আবার কোনটি গলির আড়ালে চলে গেছে।
বাজার প্রতিযোগিতায় বই হারিয়ে বস্ত্রের এই জয়ের গল্পটা সাহিত্য সংস্কৃতিপ্রেমীদের জন্য দু:খজনক। যেখানে আহমদ ছফা আর মান্নান হীরার মত ব্যক্তিরা আড্ডা দিতেন। কাজের ফাঁকে সাংবাদিক কবি, লেখকরা ছুটে এসে মিলতেন। তা এখন মূলত বস্ত্র বিপণী বিতান।
শেষমেষ সর্বসাকুল্যে এখানে মাত্র ১০ থেকে ১২টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান আছে। সেগুলোরই একটি উৎস প্রকাশন। কিন্তু নব্বইয়ের দশকে আজিজ মার্কেট গড়ে উঠেছিলো শত শত প্রকাশনা আর জ্ঞানভিত্তিক প্রতিষ্ঠান নিয়ে।
উৎস প্রকাশন-এর প্রকাশক মোস্তফা সেলিম বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপকালে জানান, ঢাকার জ্ঞান ও সাহিত্য চর্চার কেন্দ্রভূমির খ্যাতি জুটেছিলো আজিজ মার্কেটের। জন্ম হয়েছিলো বিজ্ঞান চেতনা প্ররিষদসহ বিভিন্ন আবৃত্তি সংগঠনের।
প্রকাশনা সংশ্লিষ্ট আরও কিছু দোকানপাটও ছিলো। পুরো মার্কেটটি ছিলো একই বইপাড়া।
তাই অনেকেই বলতো, ঢাকায় আজিজ মার্কেট আর কলকাতায় কলেজ স্ট্রিট।
অন্যান্য প্রকাশকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১০ বছর আগে থেকে বুটিকের একের পর দোকান আসতে থাকে মার্কেটে। আর তখনই ব্যবসা গুটিয়ে নিতে থাকেন সৃজনশীল প্রকাশকরা।
মার্কেটের মালিকরা সুযোগ বুঝে দোকানের ভাড়া এবং অগ্রিম টাকার পরিমাণ বাড়িয়ে দেন। অনেক প্রকাশকের পক্ষে সেটা দেয়া সম্ভব ছিলো না।
সম্প্রতি দুর্বৃত্তদের হামলায় নিহত জাগৃতির প্রকাশক ফসাল আরেফিন দীপনও এই টিকে থাকার সংগ্রামে ছিলেন। তার প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানটি মার্কেটের দ্বিতীয়তলায় ছিলো। কিন্তু বাড়া বৃদ্ধির কারণে তাকে উঠিয়ে দিয়ে সেখানে এখন একটি বস্ত্রের দোকান দেয়া হয়েছে।
এরপর তৃতীয় তলায় গত ৬ মাস ধরে জাগৃতির অফিস ছিলো। সেখানেই নৃশংসভাবে খুন হন এই প্রকাশক। আজিজ মার্কেটে এমন নারকীয় হামলার পর বাকিরাও মার্কেট ছাড়তে চাইছেন।
উৎস প্রকাশনের মোস্তফা সেলিমও উদ্বিগ্ন। তারওপর অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে এই মার্কেটে সৃজনশীল প্রকাশনার ব্যবসা কতদিনই করতে পারবেন তা নিয়ে ভাবনায় পড়েছেন।
কানাডা থেকে দেশে ফিরে আজিজে বসে আড্ডা দিতে চেয়েছিলেন সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল। কিন্তু এ ঘটনার পর আর ফিরতে মন চায় না। তার কবিতার কণ্ঠে ভেসে উঠে ‘সেই সম্পর্কের রক্ত স্পর্শ করে রক্ত দিয়েই/ দীপনের কপালে দিলে বিদায়ী ভাইফোঁটা!’
আজিজ সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখানে ১২০ স্কয়ার ফুটের ভাড়া মাসে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা। সঙ্গে বিশাল অংকের অগ্রিম গুণতে হয়। যে কারণে বইয়ের দোকানগুলো উঠে গিয়ে আসছে একের পর এক বস্ত্রের দোকান।
প্রকাশক মোস্তফা সেলিম জানান, সর্বপ্রথম নিত্য উপহার নামে একটি পোশাক প্রতিষ্ঠান দেশজ চেতনা নিয়ে এখনে বস্ত্র ব্যবসা শুরু করে। এরপর থেকে শাড়ি, জুতা, মোজা সব ব্যবসা এখানে আসতে শুরু করে। সামনে থেকে প্রথমে পেছনে, পরে পেছন থেকে একেবারে মার্কেট থেকে উচ্ছেদ হতে থাকেন বই ব্যবসায়ীরা।
এই মার্কেটের শুরু থেকেই আছেন প্রকাশক আনোয়ার ফরীদি। তিনি জানান, টি-শার্টের দোকানগুলোতে এখন ভরে গেছে মার্কেট। দোকান মালিকরা বেশি টাকায় টি-শার্টের দোকানদারদের কাছে দোকান ভাড়া দিচ্ছেন। তাই এখান থেকে প্রকাশকরা কেউ কনকর্ড এম্পোরিয়ামে, কেউ অন্য কোথায় চলে গেছেন।
তবে মার্কেটটা বই আর প্রকাশনার জন্য বিখ্যাত ছিলো। এখন তারা যে কজন আছেন কতদিন থাকবেন-তা নিয়ে অনিশ্চিয়তা তৈরি হয়েছে বলে জানান আনোয়ার ফরীদি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মার্কেট দোকান মালিক সমিতির সভাপতি নাজমুল আহসান বাংলানিউজকে বলেন, পোশাকের দোকানগুলো এখানে ভালো বাজার ধরতে পেরেছে। তাই তারাই বেশি ভাড়া দিতে আগ্রহী হচ্ছে। আর বইয়ের দোকানগুলো এখন একসঙ্গে কনকর্ড এম্পোরিয়ামে চলে গেছে। তবুও ১০ থেকে ১২টি প্রকাশনা এখনও মার্কেটে আছে।
বাংলাদেশ সময়: ০২৪১ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০১৫
এসএ/জেডএম