ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

যে গ্রামে ৯০ শতাংশ বাল্যবিয়ে

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০২৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪, ২০১৫
যে গ্রামে ৯০ শতাংশ বাল্যবিয়ে ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

গাইবান্ধা থেকে ফিরে: বাবা-মা শিক্ষিত, এমনকি খোদ শিক্ষিকা তার মেয়েকে বাল্য বয়সেই বিয়ে দিয়েছেন। যখন তার মেয়ে বয়স মাত্র ১৪ বছর।

তারপরও কি বলা চলে শিক্ষার হার বাড়লে বাল্যবিয়ে বন্ধ হবে!

বাংলাদেশে এখনও বাল্যবিয়ের ‍হার ৭৪ শতাংশ। কিন্তু এমন অনেক এলাকা রয়েছে যেখানে গণহারে মেয়েদের বাল্যবিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমনই একটি গ্রাম হচ্ছে গাইবান্ধার রামচন্দ্রপুর। গ্রামটিতে ৯০ শতাংশ মেয়ে বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছে বলে দাবি করেছেন একজন এনজিওকর্মী।  

এমন অনেক মেয়েকে পাওয়া গেছে যার ১২ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে গেছে। আর তের বছর বয়সে সন্তানের মা হয়েছে। যারা বেশিরভাগেই এখন নানা রকম শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ মৃত সন্তান প্রসব করেছেন। আবার কারো কারো সন্তান জন্মের কয়েক মাসের মাথায় মারা গেছে।

সভা-সেমিনারে অনেকেই বলে থাকেন, দারিদ্র্যের কারণে বাল্যবিয়ে হচ্ছে। রামচন্দ্রপুর গ্রামে দালান বাড়ি, স্বচ্ছল পরিবার। সেই বাড়ির মেয়ের বিয়ে হয়েছে নবম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে। আরেক শ্রেণি সুশীল সমাজ মনে করেন শিক্ষার অভাবে বাল্যবিয়ের হার বেশি। এ শ্রেণির লোকজন রামচন্দ্রপুরে গেলে নিজেরাই মনে হয় লজ্জা পাবেন। এমনকি নিজেদের বক্তব্য প্রত্যাহার করতে চাইতে পারেন।

আবার বলা হচ্ছে, বাল্য বিয়ের কুফল সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করতে পারলে বাল্যবিয়ে কমে যাবে। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে স্কুলশিক্ষিকা কল্পনা আক্তার কি বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে অবগত নন? তিনি কেন তার মেয়ে মানতাশা আক্তার তৃষাকে ১৪ বছর বয়সে বিয়ে দিলেন।

বাংলানিউজের এ প্রশ্ন ছিল শিক্ষিকা কল্পনা আক্তারের কাছে। তার সরল স্বীকারোক্তি ‘কখন কোন কলঙ্ক করে বসে। তখন মেয়েটার আর বিয়ে হবে না। তাই বিয়ে দিছি’।

গ্রামটিতে ঘুরলে ঘরে ঘরে মিলবে বালিকা বধূর দেখা। তাদের বেশিরভাগের পরনে শাড়ি শোভা পাচ্ছে। দূর থেকে দেখলে মনে হবে, বিশেষ কোনো উৎসবকে কেন্দ্র করে ছোট্ট মেয়েরা শাড়ি পরেছে। যেমন, শহরের মেয়েরা পহেলা বৈশাখসহ বিভিন্ন উৎসবে শাড়ি পরে আনন্দে মেতে ওঠে। তেমনি হবে হয়তো বা।

কাছাকাছি গেলে মলিন চেহারা বলে দেবে এ শাড়ি উৎসবের নয়। বিবাহ নামের শৃঙ্খলার শাড়ি। নিজের অজান্তে শাড়িই তাকে জড়িয়ে নিয়েছে। শাড়ি তাকে সব সময় মনে করে দেয়, তোমার বিয়ে হয়েছে। তুমি জলপাই গাছে উঠতে পারবে না, স্কুলমাঠের বটগাছ তলার কড়ি খেলতে যেতে পারবে না। ইচ্ছা করলেও দাঁড়িয়াবাধা কিংবা গোল্লাছুট খেলতে পারবে না।

শাড়িতে ঢেকে আছে তার গভীর অশান্তি ও বুকফাটা আর্তনাদ। কিন্তু তাদের কিছুই করার নেই। নির্মম নিয়তি হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। এখন তাদের অন্যতম দায়িত্ব, সন্তান লালন পালন ও স্বামীকে সুখী করা। স্বামীকে সুখী করতে গিয়ে জীবন গেলে বেহেস্তে যাবে সেও। মা-দাদি-নানিদের এমন কানপড়াই প্রতিনিয়ত ধ্বনিত হচ্ছে তাদের অন্তরে।

কেন অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হচ্ছে?- এ নিয়ে কথা হয় গ্রামের নারীদের সঙ্গে। তারা দাবি করেছেন, মেয়েদেরও দোষ আছে। ওরা এখন অল্প বয়সে বিপথগামী হচ্ছে। তাই ভয়েই মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দিচ্ছে।

কোনো মেয়ে বিপথে গেছে এমন উদাহরণও তারা হাজির করছেন। স্বপ্না খাতুন নামের এক গৃহিণী বলেন, রামচন্দ্রপুর হাজীপাড়ার একটি মেয়ে প্রেমের টানে একটি ছেলের হাত ধরে পালিয়ে গেছে। সে গড়দিঘি দাখিল মাদ্রাসার পঞ্চম শ্রেণিতে পড়তো। আর কেউ আছে?- এমন প্রশ্নের উত্তরে কিছুটা নীরবতা নেমে আসে। কেউ কোনো জবাব দিতে পারে না।

এনজিওকর্মী সেলিনা আক্তার বলেন, আমরা অনেক সময় অনেক ভুল কাজ করি। আর সেই ভুল কাজের পক্ষে মনে মনে নানা রকম যুক্তি দাঁড় করাই। এখানেও বাল্যবিয়ের জন্য এমন খোঁড়া যুক্তি দাঁড় করানো হচ্ছে নিজেদের মনকে বুঝ দেওয়ার জন্য।

তার মতে, অনেকগুলো গেটওয়ে রয়েছে বাল্যবিয়ে ঠেকানোর জন্য। কিন্তু কেন গণহারে বাল্য বিয়ে হচ্ছে? কথা ছিলো ১৮ বছর বয়সের নিচে কোনো মেয়ের বিয়ে রেজিস্ট্রি করবেন না কাজী। তাহলে কি রেজিস্ট্রি ছাড়াই বিয়ে দিচ্ছেন মেয়েদের? না মোটেই না। সবগুলো বিয়েরই রেজিস্ট্রি হয়েছে বলে জানা গেছে।

তাহলে কাজী কেমন করে বিয়ে রেজিস্ট্রি করলেন? ওই ইউনিয়নের প্রধান নিকাহ রেজিস্ট্রার হচ্ছেন মফিজ উদ্দিন। তার সহকারী হিসেবে ওই এলাকায় কাজ করেন মো: হালিম আলী যার বিরুদ্ধেই বাল্যবিয়ে রেজিস্ট্রি করানোর সবচেয়ে বেশি অভিযোগ। হালিম আলী বাংলানিউজকে বলেন, আমিতো ১৮ বছর বয়সের নিচে কারো বিয়ে রেজিস্ট্রি করি না। জন্ম নিবন্ধন সনদ দেখে রেজিস্ট্রি করি।

চেয়ারম্যান সনদ দিলে আমার করার কি আছে? পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন হালিম আলী। দেখেও তো বোঝা যায়, মেয়েটির বিয়ের বয়স হয়েছে কি-না? এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আমাকেতো আর আগে মেয়ে দেখায় না। বাড়ির খুলিতে বর বসিয়ে রেখে আমাদের ডাক দেয়’।

তাহলে প্রশ্ন ওঠে ১২ বছর বয়সে সুখী, খুশিদের জন্মসনদ কে দিচ্ছেন? জন্মসনদ দিয়ে থাকেন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান। রামচন্দ্রপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, বয়স অনুযায়ী সনদ দেওয়া হয়। এখানে কম-বেশি করার সুযোগ নেই। এরপর আর কিছু কিছু কি বলার থাকে?

এই যখন অবস্থা তখন বিয়ে মানেই সুখী-খুশিরা সরকারের খাতায় সাবালিকা। তাদের নিয়ে সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই। কেবল বাল্যবিয়ে ঠেকাতে যতো ক্যাম্পেইন ও দৌঁড়-ঝাপ। তাহলে বাল্যবিয়ের শিকার ৭৪ শতাংশ শিশু-কিশোরীর স্বাস্থ্যসেবা দেখবে কে? আর ৭৪ শতাংশকে বাইরে রেখে এসডিজি অর্জন খুব সহজ হবে না বলে মনে করেন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ফেরদৌস আজিম।

বাংলাদেশ সময়: ১০২৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪, ২০১৫
এসআই/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।