সুন্দরবন থেকে: নড়বড়ে কাঠের পাটাতন। তার ওপরেই পা দিয়ে নৌকায় ওঠা-নামা করতে হয়।
সুন্দরবনে আসা পর্যটকদের সবচেয়ে বেশি আগ্রহ থাকে রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও হরিণ দেখা। আর টাইগার দেখার জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় স্পট হচ্ছে, কচিখালী টাইগার পয়েন্ট ও কটকা টাইগারহিল। বাঘের সঙ্গে মিলিয়ে স্থানের নামকরণের বিষয়টি সহজেই অনুমেয়।
তবে এই দু’টি স্পটে জাহাজ বা নৌকা থেকে নামার কোনো উপায় নেই। নড়বড়ে কাঠের পাটাতনেই প্রধান ভরসা। পাটাতনগুলোর অবস্থা গ্রামে নদী শুকিয়ে যাওয়ার পর ঘাটের অবস্থা যেমন হয় ঠিক তেমনটাই।
আর তাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ওঠা-নামা করতে হয় পর্যটকদের। সুন্দরবনের ভেতরে অভয়ারণ্যে চলাচলের কাঠের সেতুগুলোর অবস্থাও অনেকটা একই রকম। এসব সেতু পার হতে গিয়ে লোকজন পা পিছলে পড়ে গিয়ে কাদায় একাকার হয়ে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত।
এতে ইচ্ছা থাকলেও দ্বিতীয়বার বনে আসার ইচ্ছা মনের অজান্তেই মিলিয়ে যায় বলে মন্তব্য করলেন কলেজ শিক্ষক আনোয়ার হোসেন।
পার্শ্ববর্তী দেশ নেপাল তার জিডিপির ৪০ শতাংশ আয় করছে পর্যটন খাত থেকে। বিশ্বের দেশে দেশে যখন পযর্টকের হার বাড়ছে, সেই সময়ে বছর বছর বাংলাদেশে পর্যটকের আগমন কমছে বলে জানিয়েছেন সুন্দরবন ট্যুরস সার্ভিস ‘সিটি ট্যুরস’র ম্যানেজার সুমন পারভেজ।
তিনি বাংলানিউজকে জানান, আগে বছরে ৯ থেকে ১১ হাজার পর্যটকের আগমন ঘটতো সুন্দরবনে। আর গত মৌসুমে মাত্র ৫ থেকে ৭ হাজার পর্যটক এসেছিলেন। বিদেশি পর্যটক ছিলেন মাত্র এক হাজারের মতো।
সুমন পারভেজ বলেন, নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস হচ্ছে পর্যটন মৌসুম। তবে অক্টোবর মাস থেকেই পর্যটকরা আসতে শুরু করেন। গত বছরের অক্টোবর মাসে তাদের কোম্পানির মাধ্যমে ৬০ জন বিদেশি পর্যটক সুন্দরবন ভ্রমণ করেন। আর এ বছরের অক্টোবরে মাত্র ৬ জন বিদেশি ভ্রমণ করেছেন।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনকে কোনোই কাজে লাগাতে পারছে না বাংলাদেশ। ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনার অভাবকেই এজন্য দায়ী করেন সুমন পারভেজ।
তিনি বলেন, এখানে এমন অনেক পর্যটক আসেন, যারা পানিকে দেখলেই ভয় পান। তবুও সাহস করে সুন্দরবন দেখতে আসেন। তারা নড়বড়ে পাটাতনে নামতে গিয়ে ভয় পেয়ে যান।
তবে আশার কথা হচ্ছে, সম্প্রতি ইউএনডিপি’র অর্থায়নে হিরণ পয়েন্ট, হারবার পয়েন্ট, জামতলা ও করমচল পয়েন্টে পন্টুন স্থাপন করা হয়েছে। এতে ওই পয়েণ্টগুলোর পরিস্থিতি অনেক ভালো হয়েছে।
হিরণ পয়েন্ট ঘুরে দেখা গেছে, সেখানে পুরনো জেটি রয়েছে। এগুলোর মধ্যে একটি মরিচা পড়ে বিবর্ণ আকার ধারণ করেছে। নতুন জেটিটি হচ্ছে বাংলাদেশ নৌ-বাহিনীর ব্যবহারের জন্য বিশেষায়িত।
সুমন পারভেজ বলেন, সবচেয়ে পর্যটকপ্রিয় কচিখালী টাইগার পয়েন্ট ও কটকা টাইগারহিলে এখন নড়বড়ে কাঠের পাটাতন দিয়ে চলছে পর্যটকদের বাঘ দর্শনের মহড়া।
টাইগারহিল সম্পর্কে তিনি বলেন, ওই এলাকায় এক সময়ে লবণের ফ্যাক্টরি ছিল, যেগুলো মাটি দিয়ে তৈরি। লবণের ফ্যাক্টরিগুলো এখন আর নেই। মাটির ঘরগুলো বসে গিয়ে উঁচু ঢিবির মতো হয়ে রয়েছে। আর বাঘ একটু উঁচু জায়গায় ভ্রমণ করতে অনেক পছন্দ করেন। সে কারণে টাইগারহিলে বাঘ দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
তার জীবনে প্রথম এই পয়েন্টেই বাঘ দেখেছিলেন বলে জানান সিটি ট্যুরস’র ম্যানেজার।
তিনি বলেন, এ পয়েন্টে নৌকা থেকে নামার জন্য যে পাটাতনটি রয়েছে তা মোটেই ব্যবহারযোগ্য নয়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ওঠা-নামা করেন পর্যটকরা।
ট্যুরিজম ডিপ্লোমা পাস করে এ পেশায় যোগ দেওয়া সুমন পারভেজ বলেন, সুন্দরবনকে নিয়ে আমাদের কোনো পরিকল্পনা আছে বলে মনে হয় না। অন্য কোনো দেশ হলে এই একটি খাত দিয়ে দেশকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতো।
তিনি মনে করেন, অভয়ারণ্যগুলোতেও বেশিরভাগ সময় প্রাণীদের দেখা পাওয়া যায় না। তাই পর্যটকদের অতৃপ্তি নিয়ে ঘরে ফিরতে হয়। পর্যটকদের দৃষ্টিগোচর হয় এমন পয়েন্টে ওই প্রাণীগুলোর জন্য খাবার দেওয়া হলে তারা নিশ্চয় খাবারের লোভে আসতো। তাতে তৃপ্ত হতে পারতেন পর্যটকরা।
বিশ্বের অনেক দেশেই এমন রেওয়াজ প্রচলিত রয়েছে। কিন্তু আমাদের বন বিভাগ গাছের পাতা কেটে দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি বলেন, সুন্দরবনে প্রশিক্ষিত গাইড নেই। পর্যটকরা এসে কিছুই জানতে পারছেন না। এজন্য সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে গাইড নিয়োগ করলে তারা পর্যটকদের সঠিক তথ্য জানাতে পারেন।
এতে একদিকে যেমন সুন্দরবনকে সঠিকভাবে তুলে ধরা হবে। তেমনি পর্যটকরা তৃপ্ত হয়ে আরো বেশি জানার আগ্রহে একাধিক দফায় সুন্দরবন ভ্রমণে আগ্রহী হবেন।
সুমন পারভেজ বলেন, কিছু কোম্পানির চিটিংয়ে কারণে পর্যটক হারাচ্ছে সুন্দরবন। কিছু কিছু ট্যুরিস্ট কোম্পানি বড় জাহাজ দেখিয়ে ছোট নৌকায় তুলছে। আবার খাবারের মান নিয়ে প্রতারণা করছে। এতে সুন্দরবনের দুর্নাম হচ্ছে। এগুলো ঠেকানো জরুরি। ঃ
সিটি ট্যুরস’র দু’টি জাহাজ রয়েছে। একটি ৭০ সিটের অপরটি ২০ সিটের। এগুলো রির্জাভ দেওয়া হয়। আবার জনপ্রতি ১০ হাজার টাকায় ৩ দিন ২ রাতের প্যাকেজ রয়েছে। প্যাকেজের মধ্যে থাকা-খাওয়া এবং বন বিভাগের এট্রি ফি যুক্ত। প্রত্যেক শুক্র, শনি ও রোববার খুলনা থেকে তাদের জাহাজগুলো ছেড়ে যায়।
তাদের ৭০ সিটের জাহাজটিতে আধুনিক সব সুবিধা বিদ্যমান। জাহাজটিতে কনফারেন্স রুম, একসঙ্গে বসে ৭০ জনের খাওয়ার সুব্যবস্থা রয়েছে। মেইল অথবা ফোনের মাধ্যমে বুকিং দেওয়া যায়।
সুন্দরবনে এসে প্রত্যেকটি পদক্ষেপে ভিন্ন রকম রোমাঞ্চ লক্ষ্য করা গেছে। কোথাও গোলাপাতার আধিক্য, আবার কোথাও সুন্দরী, কখনও ঘন কেওড়াবন পর্যটকদের স্বাগত জানাবে। নানা রকম জীববৈচিত্র্য ডিসকভারির অনেক চিত্রের চেয়ে বেশি আনন্দ দেবে বলে জানান সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র রুহুল আমিন।
ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর কিংবা পাতায়া যাওয়ার আগে নিজের দেশটাকে ভালো করে জানার অনুরোধ জানান সুন্দরবনে চতুর্থ দফায় আসা এই শিক্ষার্থী।
বাংলাদেশ সময়: ১০৪৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ২০, ২০১৫
এসআই/ এএসআর