ময়মনসিংহ: অলি, বয়স ৮ বা ৯ এর কাছাকাছি। মলিন চেহারার মতোই জীর্ণ পোশাক তার।
স্কুলের বদলে শিশু অলির এখন নিত্য যাতায়াত ময়মনসিংহ টু ফুলবাড়িয়া। এ রুটে ম্যাক্সি (স্থানীয় নাম ম্যাজিক গাড়ি) পরিবহনের শ্রমিক হিসেবে কাজ করে অলি। সারাদিন গায়ে-গতর খেটে তারে আয় হয় সাকুল্যে একশ টাকার মতো।
শ্রমিক বাবার একার উপার্জনে সংসারের খরচ চলে না বলেই এ বয়সে অলিকে নামতে হয়েছে পথে, উপার্জনের চিন্তায়। ম্যাক্সির শক্ত হাতল ধরে ঝুলতে ঝুলতে অলি বিসর্জন দিয়েছে তার শৈশবের আহ্লাদ, স্বপ্ন।
অলির বাড়ি ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার দেওখোলা মিনার বাজার এলাকায়। নিত্য অভাব ও অনটনে জর্জরিত তার পরিবার। তার বাবা মাটি কাটা শ্রমিক।
ময়মনসিংহের সড়কের উপর অবৈধভাবে গড়ে উঠা ফুলবাড়িয়া পুরাতন বাসস্ট্যান্ডে শুধু অলি একাই নয়, তার মতো এমন আরো জনা বিশেক শিশু রয়েছে যারা পরিবারের অস্বচ্ছলতা আর অভাবের তাড়নায় বাধ্য হয়ে এমন ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে জড়িয়ে পড়ছে। অভাবের বৃত্তে বন্দি হয়ে পড়েছে এসব শিশুদের শৈশব।
এদেরই একজন ১১ বছরের শিশু বিল্লাল। সদর উপজেলার দাপুনিয়া ইউনিয়নে বাড়ি তার। ম্যাক্সির হেলপারের কাজে ভয় করে না? জিজ্ঞাসা করতেই একযোগে ঝটপট উত্তর অলি আর বিল্লালের মুখে, ‘ডরাইলে কি চলবো। পেট চলবো কেমনে? আমগোর মতোন এ স্ট্যান্ডে আরো অনেক পোলাপান আছে। ’
শুক্রবার (২০ নভেম্বর) দুপুরে নগরীর ফুলবাড়িয়া পুরাতন বাসস্ট্যান্ড এলাকায় গিয়ে দেখা যায় এমন চিত্র।
দেখা গেলো, ম্যাজিক গাড়ির ছাদে যাত্রীদের মালপত্র উঠানোর কাজ করছে অলি। তাকে সাহায্য করছে কিশোর বয়সী এক ছেলে। অভাবের পরিবারে বিদ্যালয়ের চৌকাঠও মাড়ানো হয়নি তাদের।
নিজের দুর্গতির কথা শোনালো উপজেলার ভালুকজান এলাকার আনারুল (১১)। সে বললো, ‘আব্বা কাম-কাজ করে। খাওন দিবার পায় না। পেট চালাইতেই এ পেশায় আইসা পড়ছি। আমগোর কপালে লেহাপড়া নাই। এই কাম না করলে খাওন দিবো কেরা। ’
এমন অলি, বিল্লাল আর আনারুলদের সংখ্যাও নাকি দিন দিন বাড়ছে এ পেশায়। এমনটাই জানিয়ে স্ট্যান্ড সুপারভাইজার আব্দুল মোতালেব বাংলানিউজকে বলেন, ‘কাম না কইরা কি করবো। অগোর বাড়িতে অভাব। মা-বাপ আইস্যা দিয়া গেছে এ স্ট্যান্ডে। তাই ওগোরে ড্রাইভাররা নিয়া নিছে। শিশু শ্রমের কথা ভাইব্যা অগোরে বাদ দিলেও আবার আইসা পড়ে। ’
শুধুমাত্র যানবাহনের পরিবহন শ্রমিক হিসেবেই নয়, ময়মনসিংহের বিভিন্ন পোশাক কারখানাতেও সস্তায় শ্রম বিকাচ্ছে এই শিশুরা। বিশেষ করে ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় এই চিত্র এখন অতি সাধারণ ব্যাপার।
জেলার ইটখোলাগুলোতেও শিশু শ্রমিকদের কদর বেশ। কাঁচা ইট তৈরি করতে ভাটার মালিকরা কম পারিশ্রমিকে অনেক শিশুকে নিয়োজিত করেছেন। এছাড়া ওইসব ভাটাতে ট্রাক থেকে ইট নামানোর ঝুঁকিপূর্ণ কাজেও লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাদের।
আরো দেখা গেছে, নগরী ও উপজেলার বিভিন্ন ওয়ার্কশপ কারখানা, হোটেল-রেস্তোরা এমনকি গৃহকর্মী হিসেবেও রয়েছে অনেক শিশু। দিনি দিন বাড়ছে এ প্রবণতা।
ময়মনসিংহের শিশু এরিয়া ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের (এডিপি) ম্যানেজার চৌতালি রেমা বাংলানিউজকে বলেন, শিশুদের এই শ্রম থেকে ফিরিয়ে আনতে সমাজের সবার প্রচেষ্টা দরকার।
এ বিষয়ে ময়মনসিংহের এডিসি হারুন-অর-রশিদ বলেন, এই ধরণের ঘটনা আমাদের চোখে আসলে আমরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) জানাই। শিশুটির বাবা-মাকে বোঝানোর চেষ্টা করি। যেহেতু এই ঘটনা বেড়েই চলছে, আমরা অতি দ্রুত তাদের শিক্ষার আলোতে আনার ব্যবস্থা করবো। আর অবশ্যই ব্যাপারটি আমরা সমাজসেবা কর্মকর্তাকে জানাব।
এদিকে, শ্রম আইন শুধু কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকায় শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত হওয়ার মিছিল ঠেকানো যাচ্ছে না। ফলে এইসব শিশুরা বঞ্চিত হচ্ছে তাদের মৌলিক অধিকার থেকে। ২০০৬ সালের শ্রম আইনের ৪০, ৪১ ও ৪৪ ধারায় কে কাজ করতে পারবে, কতক্ষণ কাজ করতে পারবে এসব উল্লেখ থাকলেও মা-বাবা থেকে শুরু করে যারা কাজ দিচ্ছেন কেউ তা মানছেন না।
ফলে এসব শিশুর মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অপুষ্টিতে ভোগার পাশাপাশি তাদের শরীরে বাসা বাঁধছে নানান ধরণের রোগ বলে। এমনটাই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
এজন্য বেশিরভাগ শিশুদের অভিভাবকদের ইচ্ছা আর উদাসীনতাকে দায়ী করছেন সচেতন মহল।
বাংলাদেশ সময়: ০৫২০ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৩, ২০১৫
এমএএএমকে/আরএইচএস/এসআর