ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

স্যার এবারের মতো...

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৩৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৩, ২০১৫
স্যার এবারের মতো... ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

হিরণ পয়েন্ট থেকে: জরিমানা হয়েছিলো ৩০ হাজার টাকা। হাতজোড় করে বলেছিলাম, ‘স্যার এবারের মতো....’।

কথা শেষ করতে দেননি, দ্বিগুণ করে দেন জরিমানা।

কেউ এমন অফিসারের মুখোমুখি হলে, তার উপর ক্ষেপে থাকবেন- এমনটিই স্বাভাবিক বলে মনে করা হয়। কিন্তু এখানে হয়েছে ঠিক উল্টো। যে অফিসার তাকে এমন কঠোর শাস্তি দিয়েছিলেন, তাকেই এখন শ্রদ্ধার আসনে ঠাঁই দিয়েছেন।

শাস্তি দেওয়া অফিসারের গুণে মুগ্ধ হওয়ার এমন ঘটনা হয়তো বিরল। অনেকে বিশ্বাস করতেই চাইবেন না। কিন্তু সত্যি এমন ঘটনাই ঘটেছে চট্টগ্রাম বন্দরের ম্যাজিস্ট্রেট মুনীর চৌধুরীর ক্ষেত্রে।

তারই বর্ণনা শুনুন, ট্যুরিস্ট শিপ ‘এমভি জিলান’র ইঞ্জিনিয়ার প্রিন্স'র মুখে। সালটা ঠিক মনে করতে পারছেন না। সম্ভবত ২০০৬ কিংবা ২০০৭ হবে। প্রিন্স তখন চাকরি করতেন মালবাহী কোস্টার ‘সম্পদ-৩’-তে।

চট্টগ্রামের কর্ণফূলী থেকে সিমেন্টের ক্লিংকার বোঝাই করে ঢাকায় রওয়ানা দেওয়ার অপেক্ষা ছিলেন। ইঞ্জিন স্টার্ট দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছিলো। আর তখনই যমদূতের মতো হাজির হন ম্যাজিস্ট্রেট মুনীর চৌধুরী।

এসেই ওভারলোডের জন্য ৬০ হাজার টাকা জরিমানা করেন। কার্গো জাহাজটিতে ১৬শ টন ক্লিংকার থাকার কথা থাকলেও  তখন লোড ছিলো ১৭শ টন।

প্রিন্স বলেন, ওই দিন আমার কাছে ইঞ্জিনিয়ারিং সনদের (ইনল্যান্ড ভ্যাসেল ইঞ্জিনিয়ারিং সনদ) মূল কপি ছিলো না। এ অপরাধে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করেন ম্যাজিস্ট্রেট মুনীর চৌধুরী।

মাত্র কয়েক সেকেন্ডে জরিমানার কাগজ আমার হাতে ধরিয়ে দেন। এসময় মুনীর চৌধুরীর সামনে গিয়ে হাত জোড় করে বলি, স্যার এবারের মতো....। কথা আর শেষ করতে পারিনি। বলে ওঠেন, ‘তদবির করতে এসেছো! জরিমানা দ্বিগুণ করা হলো’।

বলেই খস খস করে ৬০ হাজার টাকা জরিমানার স্লিপ ধরিয়ে দেন হাতে। কিছু বলতে গিয়ে সাহস হারিয়ে ফেলি। আবার কিছু বলতে যাই, যদি আবারও দ্বিগ‍ুণ করেন!

ঘটনায় হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম। তখন খুব রাগ হয়েছিলো, ভেবেছিলাম এমন খারাপ অফিসার মনে হয় আর কেউ নেই! কিন্তু পরে বাড়ি থেকে মূল সনদ এনে তার অফিসে গিয়েছিলাম। সেদিন তাকে দেখে মনে হয়েছিলো লোকটি আসলে ফেরেশতা।

জরিমানা শোধ করার মতো অর্থ ছিল না তাই ভয়ে ভয়ে তার অফিসে গিয়েছিলাম। যদিও ভাগ্যের পরিণতি নিয়ে চিন্তিত ছিলাম। কিন্তু তার অফিসে গেলে ভিন্ন এক মুনীর স্যারকে আবিষ্কার করি।

অফিসে যেতেই আমাকে বসতে অনুরোধ করলে ইতস্ততবোধ করছিলাম। আবারও বসার জন্য অনুরোধ করেন।

বসতেই বলেন, একটি দরখাস্ত জমা দেওয়ার জন্য। আর দরখাস্ত লিখে জমা দিলে, আমাকে অবাক করে দিয়ে জরিমানা মাফ করে দেন। তাও মাত্র কয়েক মুহূর্তে।

আমি তাকে সালাম করতে চাইলে বলেছিলেন, ‘প্রিন্স সালামের বদলে আর অনিয়ম না করলে বেশি খুশি হবো’।

এরপর আরও একবার তার মুখোমুখি হতে হয়েছিলো। তখন আমি মালবাহী কার্গো ‘সম্পদ-৩’-এ চাকরি করি। কার্গোটির ফায়ার ফাইটিং যন্ত্রপাতি মেয়াদ উত্তীর্ণ ছিলো। ১০ হাজার টাকা জরিমানা করেছিলেন।

তখন আমাকে বলেছিলেন, নিজের জীবনের কী কোনোই মূল্য নেই তোমাদের কাছে। দুর্ঘটনা ঘটলে তো তোমরাই বেশি বিপদে পড়বে। জাহাজ মালিকের জীবন কিন্তু ঝুঁকিতে নেই। তাই তোমাদের সচেতন হতে হবে।

তার এ কথায় আমার অনেক ভাবনা বদলে গেছে। এখন আর ফিটনেস বিহীন কোনো জাহাজে কাজ করি না।

পিন্স বলে চলেন, তার কাছে তদবিরের কোনো স্থান ছিলো না। কথা বলতে গেলেই জরিমানা দ্বিগুণ করে দিতেন। কাউকে মেজাজ দেখাতেন না। কথা কম বলতেন, তার আর পরিবর্তন হতো না। যতো তদবিরই আসুক।

প্রায়ই সমুদ্রে আসতেন ভিজিটে। আর যদি কাউকে দেখেন নদীতে ময়লা ফেলছেন, তাহলে আর রক্ষা নেই। সোজা ৩০ হাজার টাকা জরিমানার কাগজ ধরিয়ে দেন। তার এমন তৎপরতার কারণে সমুদ্রে আবর্জনা ফেলা কমে গেছে। না হলে এতোদিন ভয়ঙ্কর অবস্থা দেখা দিতো।

হিরণ পয়েন্টে জাহাজে বসে কথা বলার সময় পানির দিকে দেখিয়ে বলেন, দেখেন পানি কতো পরিষ্কার। আগে এখানে আসলে আপনি দেখতে পেতেন খাবারের উচ্ছিষ্ট, পানি ও কোমল পানীয়ের বোতলের ছড়াছড়ি। মুনীর স্যারের কঠোর পদক্ষেপের কারণে আজ এ উন্নতি। তার কারণে সমুদ্র পরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে বলে দাবি করেন প্রকৌশলী প্রিন্স।

প্রিন্সের মতো আরও বেশ কয়েকজনকে পাওয়া গেলো যারা সবাই মুনীর চৌধুরীকে বন্দরের সবেচেয়ে যোগ্য ম্যাজিস্ট্রেট বলে আখ্যায়িত করেন। তারা প্রায় সবাই তার হাতে জরিমানার শিকার হয়েছেন। কিন্তু তারা সবাই এখন তাকে সৎ ও যোগ্য বলে মন্তব্য করেছেন।

তার এ ঘটনা শুনে পাশে বসে থাকা পিডিবি’র এক কর্মকর্তা মন্তব্য করেন, আগে ভাবতাম মানুষকে শাস্তি দিলে সে শত্রু হয়ে যায়। কিন্তু আজ দেখলাম, ভিন্ন ঘটনা। এখান থেকে অনেক বড় শিক্ষা পেলাম। সুন্দরবন ভ্রমণের এটি হবে সবচেয়ে বড় অর্জন।

আপনারা সাংবাদিকরা যদি এমন খবরগুলো লেখেন তাহলে সচেতন হবেন অফিসাররা। স্যালুট মুনীর চৌধুরী। আপনার কাছ থেকে শিক্ষা নিক অন্যরা।

মুনীর চৌধুরী নিজের নামকে এমনভাবে ব্র্যান্ডিং করেছেন, যাকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। যিনি আজ নিজেই একটি ইন্সটিটিউশন হয়ে দাঁড়িয়েছেন। যাকে অনেক বিশেষণে বিশেষায়িত করা যায়।

কেউ তাকে পরিবেশ অধিদফতরের, আবার কেউ চট্টগ্রামের বন্দরের ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে চেনেন। শুনেছি, তিনি এখন ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। নতুন আইডেনটিটি তৈরির কাজ করে যাচ্ছেন।

তবে আগের লোকজনও যে তাকে ভুলে যাননি, প্রিন্সরা তারই উদাহরণ।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৩৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২২, ২০১৫
এসআই/এসএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।