ঢাকা: ফাঁসির দড়িতে ঝোলা একাত্তরের আলবদর প্রধান আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ শুধু অপহরণ, আটক, নির্যাতন, হত্যা, গণহত্যার সঙ্গেই জড়িত ছিলেন না, তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন ধরনের সভা-সমাবেশে বক্তব্য দিয়েও মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন।
ওইসব বক্তব্যে মুক্তিকামী বাঙালিদের পাকিস্তানি হানাদার দখলদার বাহিনীর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা প্রতিরোধের যুদ্ধকে ‘ইসলামবিরোধী কার্যকলাপ’ এবং স্বাধীনতার লড়াইকে ‘অভ্যন্তরীণ ও বহিরাক্রমণ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন ইসলামী ছাত্রসংঘ সভাপতি মুজাহিদ।
এছাড়া মুজাহিদ পাকিস্তানকে ধ্বংস হতে দেবেন না উল্লেখ করেন। তিনি সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিয়ে ভারত নামক রাষ্ট্রটিকে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে ফেলে দেওয়ার হুমকি প্রদানের মাধ্যমে ধর্মীয় সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি জিঘাংসা চরিতার্থ করার জন্য প্ররোচনা দান করেন।
তার স্বাধীনতাবিরোধী এসব কর্মকাণ্ড দেশব্যাপী সভা-সমাবেশ এবং তৎকালীন সংবাদপত্রগুলোতে প্রকাশিত বক্তব্য-বিবৃতি থেকে সুস্পষ্ট হয়। এমনকি তিনি জামায়াতের পত্রিকা দৈনিক সংগ্রামে উপ-সম্পাদকীয় ও প্রবন্ধ লিখে যুদ্ধাপরাধে উস্কানি দেন।
বিচারিক আদালত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে সব পর্যায়ের বিচারিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। এমনকি প্রথমবারের মতো কোনো যুদ্ধাপরাধী হিসেবে নিজের একাত্তরের অপরাধ স্বীকার করে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষাও চেয়েছিলেন। সে আবেদন প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর শনিবার (২১ নভেম্বর) দিনগত রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতের এই সেক্রেটারি জেনারেলের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয়েছে।
চূড়ান্ত রায়ে মুজাহিদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন’১৯৭৩ এর ৩(২) এর অপরাধসমূহ যেমন, হত্যা, গণহত্যা, বুদ্ধিজীবী হত্যা, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করা, ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা, উস্কানি, সম্পৃক্ততা, বিতাড়ন, হামলা, আটক, অপহরণ ও নির্যাতনজনিত যাবতীয় মানবতাবিরোধী অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে চূড়ান্ত রায়ের ভিত্তিতে ৬ নম্বর অভিযোগে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসি কার্যকর হয়েছে তার। এ অভিযোগে সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটিতে (ঊর্ধ্বতন নেতৃত্ব) থাকা নেতা হিসেবে গণহত্যা সংঘটিত করা, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করা, হত্যা, নির্যাতন, বিতাড়ন ইত্যাদি ঘটনার পরিকল্পনা, ষড়যন্ত্রের দায়ও প্রমাণিত হয় মুজাহিদের বিরুদ্ধে। উর্ধতন অবস্থানে থাকায় আইনের ৪(১) ও ৪(২) ধারা অনুযায়ী একক এবং যৌথ অপরাধের দায়-দায়িত্বের জন্য তাকে দায়ী করা হয়। ওই আইনের ২০ ধারায়ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ সংঘটন করেছেন তিনি।
সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির অংশ হিসেবেই সভা-সমাবেশ, বক্তৃতা-বিবৃতিতে মানবতাবিরোধী অপরাধে উস্কানি দেওয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হয় মুজাহিদের বিরুদ্ধে।
১৯৭১ সালের ২২ জুলাই কুমিল্লা টাউন হলে ইসলামী ছাত্র সংঘ আয়োজিত এক কর্মিসভায় পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে উপস্থিত থেকে প্রদত্ত ভাষণে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ পবিত্র কোরআন ও সুন্নাকে অনুসরণ করে পাকিস্তানের সংহতি ও অখণ্ডতাকে রক্ষার জন্য উপস্থিত শ্রোতাদের প্রতি আহবান জানান।
১১ আগস্ট মুজাহিদ পূর্ব পকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নিখিল পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইউনুস এবং পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি মোহাম্মদ নুরুল ইসলামের সঙ্গে ঢাকায় সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক যুক্ত বিবৃতিতে জনৈক মাওলানা সাইয়েদ মাহমুদ মোস্তফা আল-মাদানীর মৃত্যুর জন্য কিছুসংখ্যক ‘দুষ্কৃতকারীকে’ দায়ী করে বলেন, ‘দুষ্কৃতকারীদের’ এর পরিণাম ভোগ করতেই হবে।
১৫ আগস্ট ‘আজাদী দিবস’ উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন প্রাঙ্গণে আয়োজিত ছাত্র সমাবেশে পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ উপস্থিত ছিলেন। সেখানে তার উপস্থিতিতে নিখিল পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী ও পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম বক্তব্য রাখেন। মুজাহিদ সমাবেশে কিছু প্রস্তাব পাঠ করেন। সমাবেশ শেষে মুজাহিদসহ ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতাদের নেতৃত্বে এক মিছিল বের হয় যাতে স্লোগান দেওয়া হয়, ‘আমাদের রক্তে পাকিস্তান টিকবে’, ‘পাকিস্তানের উৎস কি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’, ‘ভারতের দালাল খতম করো’ ইত্যাদি।
এ সমাবেশ-প্রস্তাবে বলা হয়, পাকিস্তান কোনো ভূখণ্ডের নাম নয়, একটি আদর্শের নাম। এই ইসলামী আদর্শের প্রেরণাই পাকিস্তান সৃষ্টি করেছে এবং এই আদর্শই পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম। ‘ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারত’ পূর্ব পাকিস্তানকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানের সামরিক শক্তি পঙ্গু করা এবং অর্থনৈতিক ও শিক্ষার মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেবার জন্য ভারত তাদের ‘চরদের’ মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ প্রচারণা চালাচ্ছে। কিন্তু দেশপ্রিয় নাগরিক ও পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র সমাজ তাদের সকল ‘ধ্বংসাত্মক ষড়যন্ত্রকেই’ ব্যর্থ করে দিয়েছে ও দিচ্ছে।
১৫ সেপ্টেম্বর ফরিদপুরে ইসলামী ছাত্রসংঘের এক জনসমাবেশে তিনি বলেন, সমগ্র ভারত হস্তগত করার আগে তার উচিত ছিলো আসাম (ভারতীয় প্রদেশ) দখল করা। ফরিদপুর জেলা পরিষদে অনুষ্ঠিত ওই সমাবেশে তিনি বলেন, ঘৃণ্য শত্রু ভারতকে দখল করার প্রাথমিক পর্যায়ে আমাদের আসাম দখল করতে হবে। এজন্য তিনি সমবেত ‘ইসলামপ্রিয় জনতাকে’ সশস্ত্র প্রস্তুতির আহ্বান জানান। তিনি আরও বলেন, ‘দুনিয়ার কোনো শক্তি’ই পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে পারবে না। ‘দুনিয়ার কোনো শক্তি’ বলতে মুক্তিকামী বাঙালিদের চিহ্নিত করে এ বক্তব্যে মুজাহিদ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক উস্কানি প্রদানে ‘পাকিস্তান রক্ষার নামে’ তাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রস্তুতির আহ্বান জানান।
১৫ সেপ্টেম্বর আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ‘মুজাহিদ’ পরিচয়ে জামায়াতের মুখপত্র ঢাকার দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকার ‘অস্ত্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র, যুক্তি নয়’ শিরোনামে এক দীর্ঘ নিবন্ধ প্রকাশ ও প্রচার করেন। এ নিবন্ধে পবিত্র ইসলাম ও কোরআনের নানা অপব্যাখ্যা করে তিনি লেখেন, ‘পৃথিবীর শেষ্ঠতম ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তান ও এ দেশের মানুষ আজ অভ্যন্তরীণ ও বহির্শত্রু উভয়পক্ষের শিকারে পরিণত হয়েছে। বিলম্ব হলেও বৈষম্যজনিত সমস্যা সমাধানের যখন যাবতীয় পথ উন্মুক্ত হয়ে ওঠে, তখন এ দেশ ও দেশবাসী মুসলমানদের ঘোর শত্রুরা তাদের দুরভিসন্ধি চরিতার্থ করতে এগিয়ে আসে। কেননা তারা বুঝতে পেরেছিল যে, পাকিস্তানের রাজনীতিতে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাধাণ্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এবার যদি আঞ্চলিক বৈষম্য দূরীভূত করা যায়, তা হলে এ দেশকে ধ্বংসের পরিকল্পনা চিরতরে বানচাল হয়ে যাবে।
তাই তারা বিচ্ছিন্নতা ও মুসলিম হত্যা অভিযান চালায় যার ফলে এ পর্যন্ত ‘হিন্দু গুণ্ডা’ ও তাদের এখানকার দালালরা প্রায় দু’ লাখের বেশি মুসলমানকে হত্যা করেছে বলে অনুমান করা হচ্ছে। তথাকথিত মুক্তি আন্দোলনের শ্রুতিমধুর কথা শুনে প্রথম দিকে এ দেশের কোনো কোনো মানুষ বিভ্রান্ত হলেও সকলেই এখন বুঝতে পেরেছে যে, এ আন্দোলন মুক্তির নয়, হিন্দুদের গোলাম বানানোর আন্দোলন এবং এখান থেকে ইসলাম ও মুসলমানদের খতম করে এটাকে স্পেন বানাবার আন্দোলন। মূলত এ কারণেই আজ এ দেশের ঈমানদীপ্ত মুসলমানরা জেগে উঠেছে। তারা আজ হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে। ওই বেইমান বিশ্বসঘাতক মিরজাফরদের বিরুদ্ধে।
২২ সেপ্টেম্বর কুমিল্লা টাউন হলে ছাত্র-সুধী সমাবেশে পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ বলেন, ইসলামী ছাত্র সংঘের একজন কর্মী জীবিত থাকতেও তারা পাকিস্তানকে ধ্বংস হতে দেবে না। ভারত নামের রাষ্ট্রটিকে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে ফেলে বৃহত্তর পাকিস্তান কায়েম না করা পর্যন্ত সংঘের কর্মীরা থামবে না। প্রয়োজন হলে তারা সীমান্তে গিয়ে অস্ত্র ধারণ করতেও সম্পূর্ণ প্রস্তুত রয়েছে। তিনি পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও সংহতি রক্ষার জন্য লড়াই অব্যাহত রাখতে শ্রোতাদের প্রতি আহ্বান জানান।
১৫ অক্টোবর ঢাকায় সংবাদ মাধ্যমে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আসামি আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার রাজাকারদের ভূমিকা সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্যে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের দেশপ্রেমিক যুবকরা ভারতীয় চরদের জঘন্য ষড়যন্ত্রের হাত থেকে জাতিকে রক্ষার জন্য আজ এগিয়ে এসেছে এবং রাজাকার ও অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী হিসেবে জাতির সেবা করছে। ’
তিনি বিবৃতিতে আরও বলেন, ‘যখন আমাদের দেশপ্রেমিক যুবকরা তাদের সময়, অর্থ এবং এমনকি জান কোরবানি দিচ্ছেন সে সময় এসব রাজনৈতিক নেতা বিলাসবহুল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ও অন্যান্য স্থানে অবস্থান করে আপত্তিকর মন্তব্য, বিবৃতি ও অন্যান্য কার্যকলাপের মাধ্যমে সকল দেশপ্রেমিক পাকিস্তানি নাগরিকদের নিন্দা করছেন এবং সেই সঙ্গে তাদের নিরুৎসাহিত করছেন।
তার বিবৃতিতে বলা হয়, কিছুসংখ্যক রাজনৈতিক নেতা যেমন জুলফিকার আলী ভুট্টো, কাওসার নিয়াজী, মুফতি আহমেদ এবং আসগর খান এই দেশপ্রেমিকদের নামে অসম্মানসূচক মন্তব্য করছেন। মুজাহিদ দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীকে সহায়তা করার জন্য দেশহিতৈষী ছাত্রদের প্রতি আহ্বানও জানান।
মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী মুজাহিদ ১৯৭১ সালের অক্টোবরে মতিউর রহমান নিজামীর সঙ্গে দেশের বিভিন্ন স্থানে সাংগঠনিক সফর করেন।
১৭ অক্টোবর পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের রংপুর শাখার সম্মেলনে উপস্থিত থেকে পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আলবদর বাহিনীর প্রধান আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ দেশের সার্বিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে ইসলামী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ যুবকদের সংগঠিত করে ইসলামবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য দলীয় কর্মীদের আহ্বান জানান। তিনি তার বক্তব্যে অভ্যন্তরীণ ও বহিঃআক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষায় বিভিন্ন পর্যায়ে আলবদর বাহিনী গড়ে তোলার জন্যও তাদের প্রতি আহবান জানান।
১৮ অক্টোবর বগুড়া শহরের আলতাফুন্নেছা ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দেওয়ার জন্য ছাত্র ও জনগণের প্রতি আহবান জানান।
২৫ অক্টোবর ঢাকার ইসলামী একাডেমী হলে প্রাদেশিক সদস্যদের এক সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মুজাহিদ তার বক্তব্যে পাকিস্তানের ছাত্র-জনতাকে ‘দুষ্কৃতকারী’ (মুক্তিযোদ্ধা) খতম করার দৃঢ় অঙ্গীকার নিয়ে এগিয়ে আসার আহবান জানান। সভাপতির ভাষণে তিনি পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও সংহতি রক্ষায় আত্মত্যাগে প্রস্তুত থাকার জন্যও জনগণের প্রতি আহবান জানান।
২৭ অক্টোবর রংপুর জেলা ছাত্র সংঘের সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মুজাহিদ সবাইকে জিহাদি মনোভাব নিয়ে পাকিস্তান বাহিনীর পাশে দাঁড়ানোর আহবান জানান।
২৩ অক্টোবর সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ১৭ রমজান বদর দিবস হিসেবে পালনের জন্য জনগণের প্রতি আবেদন জানিয়ে বলেন, এ বছর এ দিনটি আমাদের বিশেষ করে পাকিস্তানের মুসলমানদের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আজ ইসলামবিরোধী শক্তি ও ভারতীয় চরদের হুমকি ও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। তিনি বলেন, এ পবিত্র দিবসে আমরা জাতির স্বার্থে এবং এ দেশে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য পুনরায় আত্মোৎসর্গের শপথ গ্রহণ করবো।
মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের নেতৃত্বাধীন আলবদর বাহিনী অক্টোবরের শেষভাগে তাদের তৎপরতা বাড়িয়ে দেন এবং ৭ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকায় ‘বদর দিবস’ পালন করেন।
জামায়াত ও ইসলামী ছাত্রসংঘের উদ্যোগ ‘বদর দিবস’ পালন উপলক্ষে ঢাকাসহ প্রদেশের নানা স্থানে অনুষ্ঠিত সভা, মিছিল ইত্যাদির মাধ্যমে পাকিস্তানের প্রতি হিন্দুস্থানের আগ্রাসী মনোভাবের নিন্দা জ্ঞাপন করা হয় এবং পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও সংহতি রক্ষায় ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী ও শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আলবদর বাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য জনগণের প্রতি আহবান জানানো হয়।
৭ নভেম্বর বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে ঢাকা শহর ইসলামী ছাত্রসংঘের উদ্যোগে আয়োজিত গণজমায়েতে পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ঘোষণা করেন যে, ‘আগামীকাল থেকে হিন্দু লেখকদের বই অথবা হিন্দুদের দালালি করে লেখা পুস্তকাদি লাইব্রেরিতে স্থান দিতে পারবে না বা বিক্রি বা প্রচার করতে পারবে না। যদি কেউ করে তবে পাকিস্তানের অস্তিত্বে বিশ্বাসী স্বেচ্ছাসেবকরা জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেবে।
এ ধরনের ধর্মীয় বিদ্বেষসূচক উস্কানিমূলক বক্তব্যের পরপর ঢাকার কোতোয়ালি থানার পাটুয়াটুলীর ব্রাহ্ম সমাজের ঐতিহ্যবাহী শত বছরের পুরোনো রামমোহন লাইব্রেরির অমূল্য গ্রন্থাদি লুটপাট করা হয়।
৪ ডিসেম্বর ঢাকার চকবাজারে আলবদরের ব্যানার নিয়ে মুজাহিদ জনসমক্ষে বক্তৃতায় বলেন, দেশের বুদ্ধিজীবীদের ছাড় দেওয়া হবে না। এর সূত্র ধরেই ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ঘটে। ১০ ডিসেম্বর আলবদর বাহিনী আয়োজিত গণসমাবেশে আলবদর প্রধান ও পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি আসামি আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ হিন্দুস্থানের সম্প্রসারণবাদের প্রতি মরণ আঘাত হানার আহবান জানান। তিনি পাকিস্তানের নিরাপত্তার জন্য হিন্দুদের খতম করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে বলে জানান।
আলবদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে সমাবেশে প্রদত্ত বক্তব্যে মহান মুক্তিযুদ্ধকে ‘হিন্দুস্তানের সম্প্রসারণবাদ’ হিসেবে অভিহিত করে পাকিস্তানের নিরাপত্তার জন্য হিন্দুস্তানকে খতম করা অপরিহার্য উল্লেখ করে প্রকারান্তরে মুক্তিসংগ্রামীদের হত্যা, গণহত্যার জন্য প্ররোচনা দেন। এর ফলে তার কৃতিত্ব ও নেতৃত্বাধীন আলবদর বাহিনী এ দেশের মুক্তিকামী বুদ্ধিজীবী ও নিরীহ নিরস্ত্র মুক্তিকামী বাঙালিদের তাদের নিজ নিজ বাড়ি থেকে ধরে এনে নির্মমভাবে হত্যা করে, গণহত্যা চালায়।
বাংলাদেশ সময়: ১১১০ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৩, ২০১৫
এএসআর