ভেটখালী ঘাট থেকে: নানা রঙে আর ঢঙে সাজানো সব নৌকা। তাতে শহর-গ্রামের হাজারো মানুষ।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর থেকে সেখানে যাওয়ার পথে ভেটখালীই শেষ বাজার। নৌকাগুলো তাই এখানেই নোঙর করেছে যাত্রা শুরুর আগে শেষ কেনাকাটা সারতে। প্রয়োজনীয় কোনো কিছুই যেন বাদ পড়ে না যায়।
সারিসারি নৌকা, জ্যোৎস্নার আলোয় ভেটখালী ঘাটকে দিয়েছে নতুন রূপ। কেবল আকাশের চাঁদের আলো নয়, সঙ্গে আছে আমাদের নৌযান ‘চাঁদের আলো’।
সোমবার (২৩ নভেম্বর) রাত ১০টা ২৮ মিনিটে সকল প্রস্তুতি শেষ করে জ্যোৎস্নায় নাইতে নাইতে প্রায় গোটা চল্লিশ যাত্রী নিয়ে রাস যাত্রা শুরু করেছে আমাদের ‘চাঁদের আলো’।
এবার জেনে নিই কী এই রাস মেলা। আর কোথায় বা সেই দুবলার চর।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের পাশে ছোট্ট একটি দ্বীপ এই দুবলার চর। আর বঙ্গোপসাগরের বুকে কুঙ্গা এবং মরা পশুর নদীর মোহনায় জেগে ওঠা এ চরে দীর্ঘ কাল ধরে চলে আসছে এই রাস মেলা।
হিন্দু ধর্মাবলম্বী পুণ্যার্থীরা এ সময়ে পুণ্যস্নানের জন্য এ চরে আসেন।
তবে উৎসবটি আর শুধু হিন্দুদের নেই। নানা ধর্ম, বর্ণের মানুষের সমাগম ঘটে সাগরের এই মোহনায়।
মঙ্গলবার (২৪ নভেম্বর) থেকে শুরু হচ্ছে তিনদিন ব্যাপী এই মেলা। এদিন ভোর থেকে মেলার আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হবে। ২৬ নভেম্বর বৃহস্পতিবার পূর্ণিমা তিথিতে পুণ্য স্নানের মধ্য দিয়ে শেষ হবে। বাংলা কার্তিক মাসের শেষে বা অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম দিকের ভরা পূর্ণিমার সময় এ রাসমেলা অনুষ্ঠিত হয়। এ রাতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা পূর্ণিমার জোয়ারের নোনা পানিতে স্নান করবে।
এতে তাদের পাপ মোচন হয়ে মনের কামনা পূর্ণ হবে বলেই বিশ্বাস করে তারা। এ উপলক্ষে নানান পূজা-অর্চনার করবে হিন্দুরা। এরই ফাঁকে উড়ানো হবে ফানুসও।
মেলায় অংশ নিতে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দর্শনার্থীরা ভিড় জমিয়েছে। এছাড়া ভারত, নেপালসহ বিভিন্ন দেশ থেকেও পর্যটক আগমন ঘটছে বলে বনবিভাগ সূত্রে জানা যায়।
স্থানীয়রা জানান, দুবলার চরের রাসমেলার ইতিহাস বহু পুরোনো। বিভিন্ন জন এ মেলার ইতিহাস নিয়ে শোনালেন নানান কাহিনী। গত ৩০ বছর ধরে প্রতি বছর এ মেলায় অংশগ্রহণকারী একজন কথিত গল্প থেকে জানালেন, ১৯২৩ সালে ঠাকুর হরিচাঁদের অনুসারী হরি ভজন নামে একজন হিন্দু সাধু এ মেলা শুরু করেছিলেন। চব্বিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে সুন্দরবনে গাছের ফল-মূল খেয়ে অলৌকিক জীবন-যাপন করেন সেই সাধু।
আবার একটি মতে, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অবতার শ্রীকৃষ্ণ শত বছর আগের কোনো এক পূর্ণিমা তিথিতে পাপমোচন এবং পুণ্যলাভে গঙ্গাস্নানের স্বপ্নাদেশ পান। সেই থেকে শুরু হয় রাস মেলার।
আবার কারও কারও মতে, শারদীয় দুর্গাৎসবের পর পূর্ণিমার রাতে বৃন্দাবনবাসী গোপীদের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের রাসনৃত্যে মাতা উপলক্ষে দুবলার চরে এ রাস উৎসব পালিত হয়ে আসছে।
এর আগে মেলায় অংশ গ্রহণকারীরা জানান, এদিন সূর্য ওঠার আগেই দুবলার চরের সমুদ্র সৈকতে প্রদীপ জ্বালিয়ে প্রার্থনায় বসেন পুণ্যার্থীরা। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রেও জোয়ার শুরু হয়। জোয়ারের পানি পুণ্যার্থীদের ছুঁয়ে দিলেই তারা স্নানে নামেন।
রাসমেলায় যাত্রা উপলক্ষে সুন্দরবনের নানাস্থানে ভ্রমণের নেশায় বহু দর্শনার্থী যোগ দেন সেখানে। বিভিন্ন নৌকা ঘুরে দেখা যায়, বড় বড় সেসব নৌকায় ‘জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ’ সব ধরনের ব্যবস্থাই রাখা হয়েছে দর্শনার্থীদের জন্য। বড় বড় চুলায় রান্নার ব্যবস্থা, ড্রামে ড্রামে খাবার পানি, হঠাৎ অসু্স্থ হয়ে পড়ার আশঙ্কায় প্রয়োজনীয় ওষুধ-সেবা সবই আছে এসব নৌকায়।
চারদিনের এ যাত্রায় নৌকাতেই রান্না খাওয়ার ব্যবস্থা বনভোজনের কথাকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। চাকুরিজীবী, পেশাজীবী সবাই ব্যস্ততা থেকে ছুটি নিয়ে পরিবার আর স্বজনদের সঙ্গে ছুটে এসেছেন একসঙ্গে সুন্দরবন আর সমুদ্রকে উপভোগ করতে। চাঁদের আলোয় ছুটছে ‘চাঁদের আলো’। নৌকার যাত্রীরা সময় কাটাতে ব্যস্ত দাবা, লুডুসহ নানা খেলায়। সবারই অপেক্ষা সূর্যোদয়ের। তবেই শুরু হবে সুন্দরবনকে উপভোগ করতে করতে সাগরযাত্রার আসল আনন্দ।
বাংলাদেশ সময়: ০০৩২ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪, ২০১৫
জেপি/এটি