শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে: একটি গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। ঢাকা থেকে কনে দেখতে পাত্রপক্ষ আসবে সাতক্ষীরার কালীগঞ্জে।
যাইহোক, কালীগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে নামার পর তারা হেলিকপ্টার খুঁজতে থাকে। রাজধানীতে থেকে হেলিকপ্টার চড়ার সুযোগ না হলেও এখানে সে সুযোগ মিলবে! কিন্তু বাসস্ট্যান্ডের চেহারা দেখে তাদের মনে হয় না, এখানে হেলিকপ্টার ওঠা-নামা করতে পারে। এক পর্যায়ে আশপাশের লোকজনের কাছে হেলিকপ্টারের খোঁজ জানতে চাইলে তারা দেখিয়ে দেন।
কিন্তু একি! কোথায় হেলিকপ্টার! এতো একটি দুই চাকার সাইকেল মাত্র! যার পিছনে থাকা কেরিয়ারে করে যাত্রী বহন করা হয়। যাত্রীদের সুবিধার জন্য সেখানে কাঠের তক্তা বসিয়ে তার উপর ফোম বা হাওয়াপূর্ণ টিউব দিয়ে বসার স্থানটি আরমদায়ক করা হয়েছে।
এতক্ষণে ঘোর কাটে ঢাকা থেকে আসা মেহমানদের। এটি শুধু ওই বরপক্ষের গল্প নয়, সাতক্ষীরায় প্রথমবারের জন্য আসা প্রায় প্রতিটি লোকের গল্প।
দুই চাকার এ যাত্রীবাহী যানকে এখানে ‘হেলিকপ্টার’ বলা হয়। জেলার কালীগঞ্জ, শ্যামনগর এলাকায় এর চলনটা বেশি। তবে এখন বিলুপ্তির পথে সাতক্ষীরা অঞ্চলের এ ঐতিহবাহী যানটি। ভাড়াচালিত মোটরসাইকেলের দাপটে হেলিকপ্টার চালকরা এখন পেশা বদলাতে বাধ্য হচ্ছেন। শুধু মোটরসাইকেল নয়, ইঞ্জিন ভ্যান, চার্জার অটোরিকশাও প্রতাপের সঙ্গেই রাজত্ব শুরু করেছে মফস্বল এলাকাগুলোতে।
আবার ইঞ্জিনচালিত যানের কারণে এলাকায় পরিবেশ দূষণও বেড়েছে। কালীগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে দেখা মিললো একজন হেলিকপ্টারওয়ালার। মাথার ওপরে দণ্ডায়মান সূর্যের তেজ উপেক্ষা করে একজন যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছিলেন তিনি। কোনো যাত্রীকেই তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখা গেলো না। তবে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মোটরসাইকেল স্ট্যান্ডে যাত্রীর কমতি নেই। দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছাতে মানুষের পছন্দ এখন মোটরচালিত যানবাহন।
বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপকালে তারালি গ্রামের আক্কাস আলী নামের ওই হেলিকপ্টার চালক বলেন, তাড়াতাড়ি পৌঁছানো যায়, এক মোটরসাইকেলে ২/৩ জন মানুষ যাতি পারে। খরচও কম হয়। এসব কারণে হেলিকপ্টারে মানুষ আর চড়তি চায় না। আগে দিনে তিন চারশ টাকাও আয় করতি পারতাম। আর এখন একশ টাকার ভাড়াও টানতি পারি নে।
শ্যামনগরে আসার পরেও হেলিকপ্টারের এই দৈন্যদশা চোখে পড়লো। তবে আধিক্য ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেলের। বাস থেকে নামতেই মোটরসাইকেল চালকদের ভিড়।
সেখানে হেলিকপ্টার পাওয়া যাবে কিনা জিজ্ঞাসা করতেই একজন জানালেন, হেলিকপ্টার এখন জাদুঘরে ওঠার মত অবস্থা! মানুষ চড়তি চায় না বলে অনেকেই পেশা ছেড়ে দেচ্ছেন।
স্থানীয় অনেকেই জানান, ইঞ্জিনচালিত যানবাহনের দাপটে কোণঠাসা হয়ে পড়া হেলিকপ্টার চালকরা এখন বেশ বিপাকে। পেট চালানো দায় হয়ে পড়েছে তাদের। বাধ্য হয়ে দিনমজুরের পেশা বেছে নিচ্ছেন অনেকে। কেউ কেউ সাইকেলে ইঞ্জিন লাগিয়ে নিয়েছেন। অনেকে আবার ঋণ নিয়ে ইঞ্জিন ভ্যান কিনেছেন বলেও জানা যায়। কিন্তু সে সংখ্যাও সামান্য।
অনেক খুঁজে বংশীপুর বাসস্ট্যান্ডে একজন হেলিকপ্টারওয়ালা খুঁজে পাওয়া গেলো। রুহুল আমিন নামের ওই ব্যক্তি বাংলানিউজকে বলেন, আগে দূর দূরান্তে যাওয়ার একমাত্র উপায় ছিলো এই হেলিকপ্টার। কিন্তু এখন সবাই মোটরসাইকেলে যাতি (যাওয়া) আসতি (আসা) পছন্দ করে। খুব কাছে গেলি অল্প কিছু মানুষ এখন হেলিকপ্টারে ওঠেন।
স্থানীয় ডাক্তার জিয়াদ আলী বলেন, একসময় এখানে ভ্যানের সংখ্যাও বেশি ছিলো না। সাইকেলই ছিলো এ এলাকার সবচেয়ে দ্রুততম যান। যাত্রী পরিবহনকারী সাইকেলগুলোকে এ কারণে হেলিকপ্টার বলা হতো। সাইকেল সবসময় পরিবেশবান্ধব। দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনাও অনেক কম। কিন্তু এখন মোটরচালিত যান বাড়ায় পরিবেশের ক্ষতি যেমন হচ্ছে, তেমনি প্রতিদিন দুর্ঘটনাও ঘটছে। বহু মানুষ প্রতিবছর প্রাণ হারায় সড়ক দুর্ঘটনায়। এর একমাত্র কারণ মোটরসাইকেল, ইঞ্জিন ভানের মতো যানবাহনগুলো।
বাংলাদেশ সময়: ০৮১৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪, ২০১৫
জেপি/এএ