শেরপুর (বগুড়া) থেকে ফিরে: ঘড়ির কাটায় রাত তখন ১০টা ৫০ মিনিট। রংপুরের পীরগঞ্জ থেকে গাছের গুড়ি বোঝাই একটি ট্রাক এসে দাঁড়ালো ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কের শেরপুর উপজেলার ধুনটমোড় খাদ্যগুদামের সামনে।
ট্রাকটি কে এম শিহাব এন্টারপ্রাইজের। ট্রাকটির নম্বর সিরাজগঞ্জ -ড-১১-০০৫৯।
ট্রাকটি দাঁড়ানোর মিনিটখানেক পর ট্রাকের চালক আবু তাহের, হেলপার রবিউল ইসলাম ও কাঠের মালিক জাকির হোসেন নিচে নামলেন। যেন তারা কারো জন্য অপেক্ষা করছেন। কিছুক্ষণ পর এক খণ্ড কাগজ ও একটি হাতুড়ি নিয়ে চুপিসারে ট্রাকের দিকে এগিয়ে এলেন কামরুজ্জামান নামের এক ব্যক্তি।
তিনি শেরপুর সামাজিক বনায়ন নার্সারি ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের (এসএফএনটিসি) ফরেস্টগার্ড। দ্রুত হাতুড়ি দিয়ে ট্রাকে ভরা প্রতিটি গাছের মাথায় আঘাত করে সিল বসিয়ে দেন। সঙ্গে কাঠের মালিকের হাতে তুলে দেন কাঠগুলো শেরপুর থেকে ট্রাকে আনা হয়েছে মর্মে একটি বনজদ্রব্যের স্থানান্তরকরণ পাস। বিনিময়ে তিনি নেন এক হাজার টাকা।
এভাবেই হাতুড়ির সিলে বৈধ হয়ে যাচ্ছে অবৈধ কাঠগুলো। অবৈধ এ কাজের মাধ্যমে মাসে প্রায় ৯ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন সংশ্লিষ্ট অসাধু কর্মকর্তারা।
গত ১৬ নভেম্বর বগুড়ার শেরপুর সামাজিক বনায়ন নার্সারি ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে (এসএফএনটিসি) সরেজমিনে অনুসন্ধানকালে এ চিত্র দেখা গেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, উত্তরাঞ্চলের জয়পুরহাট, গাইবান্ধা, গোবিন্দগঞ্জ, পলাশবাড়ী, মিঠাপুকুর, রংপুর, সৈয়দপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়সহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কের শেরপুর উপজেলা হয়ে নিয়মিত অন্তত ৩০টির মতো কাঠের গুড়ি বোঝাই ট্রাক রাজধানী ঢাকায় যাচ্ছে।
আর এসব কাঠের গুড়ি বোঝাই ট্রাকগুলো শেরপুর উপজেলার ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কের গাড়ীদহ, মহিপুর, কলেজরোড, ধুনটমোড়, হামছায়াপুর, কাঠালতলা ও শেরুয়া বটতলা এলাকার বিভিন্ন স্থানে এসে দাঁড়ায়।
কারণ, বনজদ্রব্যের স্থানান্তকরণ পাস না পেলে গাড়িগুলো নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে না। সড়কের মাঝেই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কাঠগুলো অবৈধ বা চোরাই হিসেবে গণ্য করে আটকে দেবেন। এসব কাঠের মধ্যে রয়েছে ইউক্যালিপটাস, মেহগনি, সেগুন, আকাশমনি, হাইব্রিড আকাশমনি, নিম, কাঁঠালসহ বিভিন্ন জাতের কাঠের গুড়ি।
কাঠের ক্রেতা ঢাকার মানিকগঞ্জের বানিয়াজুড়ি এলাকার জাকির হোসেন বাংলানিউজকে জানান, রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার চন্দ্রবাজার মানিকের কাছ থেকে ৩৬ পিচ ইউক্যালিপটাস গাছের গুড়ি কেনেন তিনি। সেখান থেকে মানিকগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেওয়ার পথে মোবাইল ফোনে শেরপুর বন বিভাগের সংশ্লিষ্টদের কাঠের বিস্তারিত বিবরণ জানিয়ে দেন।
এরপর শেরপুর খাদ্যগুদামের সামনে পৌঁছার পর বন বিভাগের ফরেস্টগার্ড কামরুজ্জামান ও তার সহযোগী দেলোয়ার বনজদ্রব্যের স্থানান্তকরণ পাস ও হাতুড়ি নিয়ে আসেন। পরে প্রত্যেক গুড়ির মাথায় হাতুড়ির সিল বসিয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র বুঝিয়ে দেন তিনি। বিনিময়ে কামরুজ্জামানকে এক হাজার টাকা দেন তিনি। এতে করে তার কাঠগুলো বৈধ হয়ে যায়। আর কাগজে কাঠ আহরণের স্থান দেখানো হয় শেরপুরকে।
জাকির হোসেন আরো জানান, তিনি মাসে ৩-৪ ট্রাক কাঠ উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন মোকাম থেকে কেনেন। আর টাকার বিনিময়ে একই কায়দায় কাঠগুলো শেরপুর থেকে বৈধ করে নির্দিষ্ট গন্তব্যে নিয়ে যান। এভাবে অন্য ব্যবসায়ীরাও একই পন্থা অবলম্বন করে কাঠের ব্যবসা করেন। বনজদ্রব্যের স্থানান্তকরণ পাসে প্রত্যেক ট্রাক কাঠের আহরণ স্থান হিসেবে শেরপুর উপজেলার নাম উল্লেখ করা হয় বলেও তিনি জানান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বন বিভাগের একটি দায়িত্বশীল সূত্র অভিযোগ করেছে, শেরপুর সামাজিক বনায়ন নার্সারি ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ফরেস্ট রেঞ্জার আয়নাল হক এবং গাবতলী-সারিয়াকান্দি সামাজিক বনায়ন কেন্দ্রের ফরেস্টার মহীউদ্দিন আহম্মেদ ও ফরেস্টগার্ড কামরুজ্জামান একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সরকারি বিধি বিধান লঙ্ঘন করে দীর্ঘদিন ধরে এ অবৈধ কাজ করে যাচ্ছেন। তারা বনজদ্রব্যের স্থানান্তরকরণ পাস দিয়ে প্রত্যেক ট্রাক বাবদ কাঠের মালিকের কাছ থেকে আটশ’ টাকা থেকে এক হাজার টাকা ঘুষের বিনিময়ে কাঠগুলো বৈধ করে দিচ্ছেন। এভাবে সিন্ডিকেট চক্রটি মাসে প্রায় ৯ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
শেরপুর সামাজিক বনায়ন নার্সারি ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ফরেস্ট রেঞ্জার আয়নাল হক তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করে বাংলানিউজকে বলেন, শেরপুর উপজেলা থেকে প্রত্যেক মাসে অন্তত দেড়শ’ থেকে দুইশ’ ট্রাক কাঠ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যায়। এ সময় বনজদ্রব্যের স্থানান্তকরণ পাসের যেকোনো একমাসের চালান বহি দেখতে চাইলে তিনি তা দেখাতে অস্বীকৃতি জানান। পাশাপাশি তিনি বলেন, তথ্য অধিকার আইন মেনে আপনি (প্রতিবেদক) আবেদন করলে সবকিছু দেখানো হবে।
ফরেস্ট রেঞ্জারের কার্যালয় থেকে বের হয়ে আসার পর ফরেস্টগার্ড কামরুজ্জামান এ প্রতিবেদকসহ সহকর্মী এক সাংবাদিককে ঘুষ দেওয়ার প্রস্তাব দেন। পাশাপাশি এ সংক্রান্ত সংবাদ না করার জন্য অনুরোধ জানান তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ১১৩২ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪, ২০১৫
এমবিএইচ/বিএস/এএসআর