ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি

রামসাগর এখন মাদকসেবীদের অভয়ারণ্য!

মবিনুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪২৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪, ২০১৫
রামসাগর এখন মাদকসেবীদের অভয়ারণ্য! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

দিনাজপুর থেকে: দিনাজপুর শহর থেকে রামসাগরে যেতে প্রধান সড়ক থেকে একটু এগুলেই সরু রাস্তার দু’পাশে ধান ক্ষেত। হেমন্তের শেষ দিকে মাঠে পাকা সোনালী ধানক্ষেত।

একটু ভাল করে লক্ষ করলেই দেখা যায় সোনালী ধানক্ষেতের বুকে পড়ে রয়েছে নীল রংয়ের খালি বোতল।

রামসাগরে ঢুকতেই প্রধান ফটকে আমাদের পথ রোধ করলো এক গেটম্যান। টিকিট কাটতে হবে। প্রতিজন ১০ টাকা করে। দুটো টিকিট কেটে ভিতরে ঢোকার মুহূর্তে আবার বাধা। অটো রিক্সা নিয়ে যেতে হলে আরও ২০ টাকা টিকিট লাগবে।

পকেট থেকে টাকা বের করতে করতে দেখি হঠাৎ করে গেট খুলে গেল। মোটর সাইকেল নিয়ে দুজন লোক বিনা টিকিটেই ভিতরে প্রবেশ করলো। আমার সাথে যাওয়া বাংলানিউজের দিনাজপুর জেলা প্রতিনিধি মাহিদুল ইসলাম রিপন অনুচ্চ স্বরে বললেন এখানে পর্যটকদের টিকিট লাগে। ফেন্সিডিলসেবীদের টিকিট লাগে না।

গেটে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে টিকিট বিক্রি করছিলেন জালাল নামের এক লোক। তিনি বললেন, আপনি না জেনেই এ কথা বলছেন যিনি ভিতরে গেলেন তিনি আমার ভাতিজা। রিপন বললেন, একটু দাঁড়াই, এরপর দেখবো আপনার ভাগ্নে, মামা, খালু একে একে প্রবেশ করবে তাদের কারও টিকিট লাগবে না।

দুই মিনিট অপেক্ষা করতেই সত্যি সত্যিই ভাগ্নে, মামা-খালুরা গেটে এসে উপস্থিত। তাদের দেখামাত্রই গেট আগলে থাকা লোকটি গেট খুলে দিচ্ছেন। তারা ভিআইপি মর্যাদায় ভিতরে ঢুকছেন। তাদের টিকিট লাগে না।

গেট দিয়ে প্রবেশ করে ২৫ গজ সামনে গেলেই দুই পাশে অবাধে পড়ে থাকা ফেন্সিডিলের বোতলগুলো আমাদের স্বাগত জানালো। আমরা দিঘির পশ্চিম পাড় দিয়ে ইট বিছানো সরু রাস্তা ধরে এগিয়ে চললাম।

নাম রামসাগর হলেও এটি কিন্তু সাগর  নয়, এমনকি নদীও নয়। এটি মানুষের হাতে গড়া বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দিঘি।   লোকমুখে এটি রামসাগর বলে প্রচারিত হতে হতে এক সময় দিঘিটি রামসাগর হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে।

১৯৬০ সালে রামসাগরকে বন বিভাগের তত্ত্বাবধানে আনা হয়। ১৯৯৫-৯৬ সালে রামসাগরকে আধুনিক পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হয়। ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল রামসাগরকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

পার্কের ভিতরে টানানো পরিচিতি সাইনবোর্ড অনুযায়ী দিঘিটির দৈর্ঘ্য ৩ হাজার ৩৯৯ ফুট আর প্রস্থ ৯৯৮ ফুট। দিঘিসহ উদ্যানটি ১৪৬.৪৪ একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত। এর মধ্যে ভূমির পরিমাণ ৬৮.৫৪ একর ও দিঘিটি ৭৭.৯০ একর জায়গা দখল করে আছে।

দিনাজপুর সদর থেকে ৮ কিলোমিটার দক্ষিণে তাজপুর গ্রামে অবস্থিত এই রামসাগর জাতীয় উদ্যান। পথে শিকদার হাটে খেয়ে নিতে পারেন আশু পান স্টোর থেকে ৫ টাকার বিনিময়ে একটি মিষ্টি পান। হরেক রকম মসল্লা দিয়ে বানানো এ পান আপনার ভাল লাগবে নিঃসন্দেহে।

রামসাগর জাতীয় উদ্যানের সাইনবোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, পলাশী যুদ্ধের মাত্র কয়েকবছর আগে ১৭৫০-১৭৫৫ খ্রিষ্টাব্দে রাজা রামনাথ এটি খনন করেন।
কথিত আছে, ১৭৫০-১৭৫৫ খ্রিষ্টাব্দে কোন এক সময় বৃষ্টির অভাবে খরায় সারাদেশে দুর্ভিক্ষ হয়। খাদ্য ও পানীয় জলের অভাবে মারা যান অনেক লোক। রাজা হাজার হাজার লোক নিয়োগ করে দ্রুততম সময়ে খনন করলেন এ দিঘি। কিন্তু তাতে কোন পানি উঠলো না। রাজা স্বপ্নে আদেশপ্রাপ্ত হন যুবরাজ রাম দিঘির পানিতে প্রাণ বিসর্জন দিলেই তাতে পানি উঠবে। স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী যুবরাজ দিঘির পানিতে প্রাণ বিসর্জন দিলেন। দিঘি পানিতে ভরে উঠলো। পানীয় জলের অভাব দূর হলো। রাজার নির্দেশে যুবরাজের নামানুসারে দিঘির নামকরণ হয় রামসাগর।

কী আছে রামসাগরে?
রামসাগরের স্বচ্ছ, নীল আর স্থির জলরাশি মুহূর্তেই মনে প্রশান্তি এনে দেবে। মূল দিঘির চারপাশ জুড়ে রয়েছে অপ্রশস্ত ইট বিছানো পাকা রাস্তা। রাস্তার দুধারের দেবদারু, শিশু, নারকেল, জারুল, অর্জুন, আমলকী, হরতকী, বহেড়া, তেঁতুল, মেহগনি, পলাশ, ইউক্যালিপটাসসহ হাজারো গাছ, নানান প্রজাতির ফুল ও ফলের গাছ, হরেক রকমের ঔষধি গাছ আপনাকে আনন্দ দেবে। দিঘির মাঝ বরাবর পশ্চিম পাশে রয়েছে একটি মিনি চিড়িয়াখানা। সেখানে রয়েছে দুটো অজগর সাপ, বানর ও অনেকগুলো হরিণ। রয়েছে একটি শিশুপার্ক। কৃত্রিমভাবে বানানো বিভিন্ন জীবজন্তুর প্রতিকৃতি।

রাস্তার একপাশে রামসাগরের স্বচ্ছ স্থির জলরাশি আর অপরপাশে উঁচু উঁচু কৃত্রিম টিলায় নয়নাভিরাম সবুজের সমারোহ। টিলাজুড়ে পাখিদের আড্ডা আর কলকাকলিতে রামসাগরে সব সময়ই উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করে। বিভিন্ন ধরনের পাখির পাশাপাশি দিঘির জলে এসে বসে পানকৌড়িও। এখানে রয়েছে সাতটি পিকনিক কর্ণার। তবে অযত্ন অবহেলায় পিকনিক স্পটগুলোর বেহাল দশা।

মাদকসেবীদের অভয়ারণ্য রামসাগর
অপেক্ষাকৃত নিরাপদ হওয়ায় দিনাজপুর ও রামসাগরের আশেপাশের মাদকসেবীদের অভয়ারণ্য হচ্ছে রামসাগর। পার্কের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখা গেছে খালি ফেন্সিডিলের বোতল। পার্কে যারা নিয়মিত আসেন ও পার্কের দোকানদারদের সাথে কথা বলে জানা গেছে রামসাগরের আশেপাশেই মাদক ব্যবসায়ীদের রাজত্ব। অপেক্ষাকৃত নিরাপদ হওয়ায় তারা ফেন্সিডিলসহ অন্যান্য মাদকদ্রব্য কিনে রামসাগরের ভিতরে এনে তা সেবন করে। এছাড়া আগে পার্কের ভিতরেও এসব পাওয়া যেত একসময়। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে মাদক ব্যবসায়ীরা কয়েকবার আটক হওয়ার পর প্রকাশ্যে বিক্রি কিছুটা কমেছে। ছিনতাইয়ের ঘটনাও কিছুটা কমেছে।

কী ভাবে যাবেন?
দেশের যেকোন স্থান থেকে দিনাজপুরের যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত ভালো। ঢাকা থেকে হানিফ, নাবিল, বাবলুসহ যেকোন বাসে কিংবা ট্রেনযোগে দিনাজপুর এসে নামতে হবে। এরপর ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সায় ৩০ মিনিটেই রামসাগর যাওয়া যায়। রাস্তাঘাট খুবই ভালো। তবে রামসাগরে মাদকসেবীদের দৌরাত্ম্যের পাশাপাশি রয়েছে ছিনতাইকারীদের উৎপাত। তাই দিনের আলো থাকতে থাকতেই সেখান থেকে ফিরে আসা ভালো।

কোথায় থাকবেন
দিনাজপুরে মালদাপট্টি, বাহাদুরবাজার, গণেশতলায় কিছু আবাসিক হোটেল আছে। একদিনের জন্য ২০০-৫০০ টাকা ভাড়ায় থাকতে পারবেন। দিনাজপুরের আসলে আরও কিছু ঐহিতাসিক স্থান যেমন কান্তজির মন্দির, নয়াবাদ মসজিদ, সুখ সাগর, মাতা সাগর, স্বপ্নপুরী, রাজবাড়ী প্রভৃতি ঘুরে যেতে পারেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৪২৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪, ২০১৫
এমআই/আরআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।