শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার): ১৯২৬ সালে শ্রীভূমি সিলেট ভ্রমণে এসে মনিপুরী তরুণীদের পরিবেষ্টিত রাসনৃত্য উপভোগ করে দারুণভাবে মুগ্ধ হয়েছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
পরবর্তীতে রবি ঠাকুর মনিপুরীদের নৃত্যশিক্ষক কমলগঞ্জের নীলেশ্বর মুখার্জিকে সসম্মানে শান্তি নিকেতনে নিয়ে ‘মনিপুরী নৃত্য বিভাগ’ চালু করেছিলেন।
এমন অনেক খ্যাতি ছড়িয়ে আছে মনিপুরীদের রাসলীলায়। রবীন্দ্রনাথ নিজেও সে শিল্পের স্বাদ ভুলে থাকতে পারেননি। নৃত্যগীতের মাধ্যমে জীবাত্মা আর পরমাত্মার মানসিক মিলনই যে মহারাসলীলার নিবিড় সন্তুষ্টি।
বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে বুধবার (২৫ নভেম্বর) মৌলভীবাজারের সীমান্তবর্তী কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর এবং আদমপুরে সাড়ম্বরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে মনিপুরী সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব মহারাসলীলা।
রাসোৎসব উপলক্ষে দুই জায়গাতেই বসেছে ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ মেলা। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে মনিপুরী সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরাজ করছে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা। তাদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন আশপাশের এলাকার অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষও।
তুমুল হৈ-চৈ, আনন্দ উৎসাহে ঢাক-ঢোল, খোল-করতাল আর শঙ্খধ্বনি মধ্য দিয়ে হিন্দুধর্মের অবতার পুরুষ শ্রীকৃষ্ণ ও তার সখি রাধাকে ঘিরে এই একটি দিন বছরের আর সব দিন থেকে ভিন্ন আমেজ নিয়ে আসে কমলগঞ্জবাসীর জীবনে।
আয়োজকরা বলছেন, কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর (শিববাজার) জোড়ামণ্ডপ প্রাঙ্গণে বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরীরা ১৭৩তম বার্ষিকীর আয়োজন করেছে মনিপুরী মহারাসলীলা সেবা সংঘ।
আর আদমপুর ইউনিয়নের তেতইগাঁও সানাঠাকুর মণ্ডপ প্রাঙ্গণে রাসোৎসব উদযাপন কমিটির উদ্যোগে মনিপুরী মৈতৈ সম্প্রদায়ের লোকজন ৩০তম মহারাস উৎসব উদযাপন করবে।
সরেজমিনে দেখা যায়, মনিপুরী সম্প্রদায়ের লোকজনের পাশাপাশি অন্যান্য জাতি, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে হাজার হাজার লোকজনের উপস্থিতে মেতে উঠছে এ আনন্দ উৎসব।
মনিপুরী সম্প্রদায়ের পূণ্যস্থান হিসেবে বিবেচিত মাধবপুর ও আদমপুরে রাসোৎসবের জন্য তৈরি সাদাকাগজের নকশায় সজ্জিত মণ্ডপগুলো বুধবার রাতে হয়ে উঠবে লাখো মানুষের মিলন মেলা।
মনিপুরী শিশু নৃত্যশিল্পীদের সুনিপুণ নৃত্যাভিনয় রাতভর মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখবে ভক্ত ও দর্শনার্থীদের।
মনিপুরী মহারাসলীলা সেবা সংঘের সভাপতি অ্যাডভোকেট চাঁদ মুরারী সিংহ স্বপন ও সাধারণ সম্পাদক নৃপেন্দ্র কুমার সিংহ বাংলানিউজকে জানান, মাধবপুর জোড়া মণ্ডপ প্রাঙ্গণে বুধবার সকাল ১১টা থেকে গোধূলীলগ্ন পর্যন্ত রাখাল নৃত্য (গোষ্ঠলীলা), সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত গুণীজন সংবর্ধনা, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে।
রাত সাড়ে ৯টা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত নট সংকীর্তন, রাত ১১টা থেকে পরদিন বৃহস্পতিবার ঊষালগ্ন পর্যন্ত কৃষ্ণের মহারাসলীলানুসরণ অনুষ্ঠান।
এসব অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন।
মহারাস উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক বীরেন্দ্র সিংহ ও সদস্য সচিব রানা বাবু সিংহ জানান, আদমপুর তেতইগাঁও উন্মুক্ত মঞ্চে বুধবার সকাল ১০টায় রাখাল নৃত্য, সন্ধ্যা সাড়ে ৫টায় আলোচনা সভা, সন্ধ্যা ৭টায় মনিপুর ভারত ও বাংলাদেশের স্থানীয় শিল্পী মনিপুরী গানের দল ‘মৈরিক’র অংশগ্রহণে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, রাত ১১টায় নিপাপালা, রাত সাড়ে ১১টায় মহারাসলীলা অনুষ্ঠিত হবে।
এতে প্রধান অতিথি থাকবেন জাতীয় সংসদের হুইপ শাহাব উদ্দিন।
এদিকে কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর তেতইগাঁওস্থ শ্রীমধুমঙ্গল শর্ম্মার মণ্ডপে মৈতৈ মণিপুরিদের আয়োজনে এবার প্রথমবারের মতো রাসোৎসবের আয়োজন করা হয়েছে।
মহারাস উৎসব উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক চন্দ্রকীর্তি সিংহ জানান, তেতইগাঁও মণিপুরি কালচারাল কমপ্লেক্স প্রাঙ্গণের উন্মুক্ত মঞ্চে বুধবার সকাল ১১টায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের রাখাল নৃত্য, সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় আলোচনা সভা, রাত ৭টায় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা অনুষ্ঠিত হবে।
এছাড়া রাত ১০টায় নটকীর্ত্তণ অধিবাস, রাত ১১টায় ভগবান কৃষ্ণের মহারাসলীলা হবে।
অনুষ্ঠান উদ্বোধন করবেন জাতীয় সংসদের সাবেক চিফ হুইপ ও মৌলভীবাজার জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি উপাধ্যক্ষ মো. আব্দুস শহীদ।
প্রধান অতিথি হিসেবে থাকবেন হুইপ শাহাব উদ্দিন।
মনিপুরী সম্প্রদায়ের প্রবীণ বিধু ভূষণ সিংহ বাংলানিউজকে বলেন, ১৭৭৯ সালে মনিপুরের মহারাজা ভাগ্যচন্দ্রস্বপ্নদৃষ্ট হয়ে যে নৃত্যগীতের প্রর্বতন করেছিলেন তা-ই রাসোৎসব। ভাগ্যচন্দ্রের পরবর্তী রাজাদের বেশরিভাগই ছিলেন নৃত্যগীতে পারদর্শী এবং তারা নিজেরাও রাসনৃত্যে অংশ নিতেন।
‘ফলে মনিপুরীদের মধ্যে এ কৃষ্টির ধারাবাহিকতায় কোনো ছেদ পড়েনি। অতীতের মতো প্রতিবারই কোনো বিকৃতি ছাড়া এখানে মহারাসলীলা উদযাপন করা হয়,’ যোগ করেন তিনি।
এদিকে রাসোৎসব উপলক্ষে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে এসব এলাকায় কঠোর নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ২১২১ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৫, ২০১৫
বিবিবি/এমএ