ঢাকা: ‘আমার সব শেষ। আমি ধ্বংস হয়ে গেলাম।
এ এক পাগলপ্রায় বাবার হৃদয় নিংড়ানো কষ্টের ভাষা। যার ছেলে তার স্ত্রীকে হত্যা করেছে। আর এ হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ধ্বংস হয়ে গেছে একটি সাজানো-গোছানো পরিবার।
ঘটনাটি রাজধানী মিরপুর বড়বাগের। এলাকার ৬৭/২নং বাড়ির দ্বিতীয় তলায় দুই ছেলেসহ বসবাস করতেন মতিউর রহমান ও তার স্ত্রী রেহানা আক্তার (৪০)। বড় ছেলে মিরাজ রহমান (২০) ও ছোট ছেলে মহসির রহমান (১৪)। চাকরির সুবাদে বেশিরভাগ সময় মতিউর রহমানকে থাকতে হতো দিনাজপুর। আর দুই ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করার জন্য রেহানা বেগম থাকতেন ঢাকার ওই বাড়িতে।
সবকিছু ভালোই চলছিলো। হঠাৎ ঘটলো সেই ভয়ঙ্কর হত্যার ঘটনা। গত ০২ নভেম্বর রাত ১টার দিকে ছুরিকাঘাতে আহত হন রেহানা আক্তার। গুরুতর অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। ৬ নভেম্বর বিকেলে ঢামেক হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।
প্রথমে রেহানার ওপর ছুরিকাঘাতের ঘটনাকে ডাকাতির ঘটনা বলে চালিয়ে দিতে চেয়েছিলেন স্বজনরা। পরে এলাকার প্রতিবেশিদের কাছ থেকে জানা যায়, ছেলে মিরাজ তার মাকে ছুরিকাঘাত করেন।
এ ঘটনায় মিরপুর মডেল থানায় মামলা করেন (মামলা নং ১৩) নিহত রেহানার মা মনোয়ারা বগম (৭০)। ঘটনার পর থেকে পলাতক রয়েছেন নিহতের বড় ছেলে মিরাজ। কিন্তু মামলার পর থেকে নিশ্চুপ হয়ে আছেন বাদী। এর কারণ কি? আসলেই কি তাহলে মাকে খুন করেছেন ছেলে?
রহস্যজনক ওই ঘটনার বিষয়ে জানতে সম্প্রতি ওই বাড়িতে গেলে মতিউর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ‘কি করে কি হয়ে গেলো কিছুই জানি না। শুধু জানি নিছক রাগের বশে ঘটে গেছে একটি চরম দুর্ঘটনা। কি করবো আমি এখন? আত্মহত্যা করারও সুযোগ নেই আমার’!
জানালেন, ‘ছোট ছেলে মহসিনের জেএসসি পরীক্ষা ছিল। সে ভালোভাবে পরীক্ষা দিয়েছে কি-না সেটাও জানি না। এ বাড়ি ছেড়ে দিয়েছি। ছোট ছেলেকে নিয়ে শিগগিরই মানিকগঞ্জে চলে যাচ্ছি। আত্মীয়-স্বজন কারও কাছে মুখ দেখাতে পারছি না। সবাই যে যার মতো সরে পড়েছেন। আমি একাই শুধু যুদ্ধ করছি’।
সব হারিয়ে নীতির জায়গা থেকেও কিছুটা পিছপা’ হয়েছেন তিনি। তাই তো বাদিনীকে বলে মামলাও তুলে নিতে চাইছেন এখন।
তাহলে অপরাধীর বিচার হোক এটা কি চান না?- এ প্রশ্নের জবাবে মতিউর রহমান বললেন, ‘ওর বিচার হচ্ছেই। ও এখন ছন্নছাড়া হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে। এ পাপের শাস্তি সে এমনিতেও পেয়ে যাবে’।
আসামি মিরাজ অর্থাৎ তার ছেলের সঙ্গে তার যোগাযোগ আছে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ও আমার ছেলে নয়। ওর সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। ওর মুখ আমি আর কখনো দেখতে চাই না’।
ওই বাড়ির নিচতলার ভাড়াটিয়া মমতাজ জানান, রেহানা আক্তার অত্যন্ত ভালো এবং চরিত্রবান মহিলা ছিলেন। তবে তার ছেলে মিরাজ খুব গম্ভীর স্বভাবের ছিলেন। কারো সঙ্গে কথা বলতো না। ঘটনার রাতে মা আর ছেলের মধ্যে বাক-বিতণ্ডার শব্দ শোনা যায়। এরপর সকালে উঠে তারা জানতে পারেন যে, রেহানা আক্তারকে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে।
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, আসামি মিরাজ এইচএসসি পাস করে বেকার বসেছিলেন। বিদেশ যাওয়ার জন্য প্রায় তার মা নিহত রেহানা বেগমকে চাপ দিতেন। ওইদিন রাতেও একই কারণে তার মার কাছে টাকা চেয়ে বসেন মিরাজ। সংসারের অর্থনৈতিক অবস্থার কথা চিন্তা করে টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে কাছে থাকা লোহার/স্টিলের ধারালো ছুরি দিয়ে রেহানা বেগমের পেটে আঘাত করেন মিরাজ।
পরে তাকে ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হয়। সেখানে সেবা করার সময় মা মনোয়ারা বেগম খুনের ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করেন রেহানা বেগম।
ওইদিন বিকেলে মিরপুর থানায় বাদী হয়ে মামলা করেন মনোয়ারা বেগম। এ সম্পর্কে জানতে মনোয়ারা বেগমের মুঠোফোন বার বার ফোন করলেও ফোন রিসিভ করেননি তিনি।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ভূঁইয়া মাহবুব হাসান বাংলানিউজকে জানান, প্রথমদিকে নিহতের স্বজনরা ডাকাতির ঘটনা বলে চালিয়ে দিলেও পরে তদন্ত করে জানা যায়. আসলে ছেলে মিরাজই তার মাকে খুন করেছেন।
তিনি আরো জানান, আসামির ছোট ভাইসহ সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এলাকার প্রতিবেশীরাও জানিয়েছে, আসামি মিরাজ সম্পর্কে কোনো খারাপ তথ্য নেই। তার মায়ের সম্পর্কেও খারাপ কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। মূলত তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে ঝগড়া বিবাদের জের ধরেই এ ঘটনা ঘটেছে।
মিরাজকে আটক করা চেষ্টা চলছে বলেও জানান পুলিশের এ কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ সময়: ২০৩৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০১৫
জেডএফ/এএসআর