ঢাকা: ঢাকার নবাবদের আবাসিক প্রাসাদ ও জমিদারির সদর কাচারির পূর্ব গেটের কাছে নদীর পাড় ধরে যে রাস্তা পূর্ব দিকে গেছে, সেটিই সমসন রোড। শহর রক্ষার জন্য এক কালে যে বাঁধ নির্মিত হয়েছিল, সেই বাকল্যান্ড বাঁধটির বর্তমান নাম এটা।
ঢাকা শহরের পাশ দিয়ে আজও বয়ে চলেছে সেই বুড়িগঙ্গা নদী, নদীপাড়ে বাকল্যান্ড বাঁধটিও রয়েছে। ঐতিহাসিক এই স্থানের পুরনো সেই মহিমা খুঁজে পাওয়া আর সহজ নয়। তবে পাকিস্তান আমল থেকে কালের স্মৃতি ধরে রেখে এখানে রয়ে গেছে ‘ভাসমান বোর্ডিং’। মাত্র ৩০ টাকায় রাত্রিযাপনের বন্দোবস্ত বর্তমান সময়ে যেন কল্পানাতীত!
সদরঘাট এলাকায় ব্যবসায়ী ও লঞ্চযাত্রীদের কথা চিন্তা করে পাকিস্তান আমলে শুরু হয় বুড়িগঙ্গা নদীর ওপর কাঠের তৈরি নৌকার মেসে থাকার ব্যবস্থা। ঘাট এলাকায় রাত্রিযাপনের লক্ষ্যে মেজর শফিউল্লাহ এই উদ্যোগ নেন। তখন ওই সব মেসে রাতে টাকা দিয়ে খাবার কিনে খেলে বিনে পয়সায় থাকতে দেওয়া হতো। এখন অবশ্য সেই দিন নেই। সময়ের সাথে সবকিছুর পরিবর্তন হয়েছে। দুই/তিনতলা বিশিষ্ট লঞ্চ ব্যবহৃত হচ্ছে বোর্ডিং হিসেবে। বর্তমানে বিআইডব্লিউটিএ বোর্ডিংগুলোর তত্ত্বাবধান করে।
শুক্রবার দিনগত (১৩ নভেম্বর) গভীর রাতে রাজধানীর বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে গিয়ে দেখা গেছে সদরঘাটের পশ্চিমে আহসান মঞ্জিলের গেটের কাছে বিআইডব্লিউটিএ’র ট্রানজিট সেডের নিচে নদীতে পাঁচটি নৌকার বোর্ডিং।
এর মধ্যে তিনটি বোর্ডিং কেরানীগঞ্জের নুরু চেয়ারম্যানের ভাই নয়া মিয়ার। আর একটি হাজি আব্দুস সাত্তারের। নয়া মিয়ার তিনটি বোর্ডিং ভালোভাবেই চলছে। মেরামত না করে ফেলে রাখা হয়েছে বাকি একটি।
পানিতে ভাসমান নৌকা বোর্ডিংয়ের কোনোটা তিনতলা কোনোটা দোতলা। তবে নিচতলায় ভারতের স্লিপার ট্রেনের মতো করে দোতলা বানিয়ে শুয়ে থাকার জায়গা করা হয়েছে। পাশে রয়েছে ছোট ছোট জানালা বুড়িগঙ্গার বাতাস প্রবেশের জন্য। এসব বোর্ডিংয়ে থাকেন সদরঘাটের হকার, ফেরিওয়ালা ও আশপাশের ভ্রাম্যমাণ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। যাদের এখানে থাকার টাকাও নেই তারা থাকেন ঘাটের সিঁড়িতে।
রাত দেড়টার পরে বোর্ডিংয়ের ভেতরে গিয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে জানা গেলো মাত্র ৩০ টাকায় এখানে রাত্রিযাপন করা যায়। তবে রুম নিয়ে থাকতে চাইলে গুণতে হবে ৭০ থেকে ৭৫ টাকা। ছাদে গোসলের রয়েছে ব্যবস্থা, বোর্ডিংয়ের শেষ মাথায় রয়েছে টয়লেট।
নয়া মিয়ার তিনটি বোর্ডিংয়ের একটিতে ম্যানেজার হিসেবে কাজ ৩৫ বছর ধরে কাজ করছেন মো. মাসুদ। তিনি বলেন, ঢালা বিছানায় প্রতিরাতের জন্য লাগে মাত্র ৩০ টাকা। খাওয়া ছাড়া অন্য সব ব্যবস্থা আছে। আর রুম নিয়ে থাকতে চাইলে ৭০ টাকা লাগবে। বোর্ডিংয়ে দেড়শ জনের বেশি থাকা যায় না। রুম রয়েছে ৫০টি। আর রয়েছে ঢালাও বিছানা।
মাসুদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী প্রতিরাতে বোর্ডিং থেকে আয় হয় সাড়ে ৬ হাজার টাকা। তবে বর্তমানে বোর্ডিং মেরামতের কাজ চলায় লোক কম রাখা হচ্ছে। নয়া মিয়ার তিন বোর্ডিংয়ে প্রতিরাতে আয় হয় প্রায় ২০ হাজার টাকার মতো। বিআইডব্লিইটিএ’র ভাড়া নামমাত্র। সঙ্গে রয়েছে বিদ্যুৎ বিলের খরচ।
হাজি আব্দুস সাত্তারের বোর্ডিংয়ের ম্যানেজার সাইদুল ইসলাম জানান, তার বোর্ডিংয়ে ঢালাও বিছানায় রাত্রিযাপন করতে লাগে ৩০ টাকা। রুম নিলে ৭৫ টাকা।
এই নৌকা বোর্ডিংয়ে ম্যানেজারের রুম ছাড়া রুম রয়েছে ৫৩টি। আরো প্রায় ৫০ জনের মতো লোক ঢালাও বিছানায় শুয়ে থাকেন। ম্যানেজার সাইদুলের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী এই বোর্ডিংয়ের আয়ও প্রতি রাতে সাড়ে ৬ হাজার টাকার মতো।
খোঁজ নিয়ে জানা যায় ব্রিটিশ আমলে জাহাজের অধস্তন কর্মচারীদের থাকার জন্য ভেঙে যাওয়া জাহাজ দিয়ে ভাসমান নৌকা বোর্ডিং তৈরির এই রেওয়াজ চালু হয়। পরে তা বাণিজ্যিক রূপ পায় পাকিস্তান আমলে।
বোর্ডিংগুলোতে টয়লেটের মল অপসারণের ব্যবস্থা করা হয় সরাসরি নদীর পানিতে। ঘাটের কাছে ভাসমান নৌকা বোর্ডিংয়ের এই নোংরা কাজটি বৃটিশরা শুরু করলেও তা এখনও ধরে রেখেছে বিআইডব্লিইটিএ। যদিও নদী দূষণমুক্ত করতে বারবারই ঘোষণা দিচ্ছেন নৌ পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান।
বিআইডব্লিইটিএ’র ট্রানজিট সেড ভাড়া নিয়ে যারা দোকান করেছেন তাদের অনেকেই সেডের পাশে তৈরি করেছেন পাবলিক টয়লেট। ট্রানজিট সেড-১ এবং ট্রানজিট সেড-২ এর কাছে কলার আড়তদার কুদ্দুস করেছেন একটি পাবলিক টয়লেট। পাশেই রয়েছে আলাউদ্দিনের পাবলিক টয়লেট। এ দু’টি পাবলিক টয়লেটের মল গিয়ে সরাসরি পড়ছে বুড়িগঙ্গায়।
এলাকাবাসীরা জানান বাদামতলী থেকে সদরঘাট পর্যন্ত এরকম প্রায় ৫০টির বেশি পাবলিক টয়লেট রয়েছে; এসব টয়লেটের মল সরাসরি বুড়িগঙ্গায় পড়ছে। যদিও নৌ মন্ত্রী শাজাহান খান কয়েক মাস আগে সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন ওয়াইজঘাট পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। সদরঘাট এখন আর আগের মতো নাই।
সমসন রোডের পাশে বুড়িগঙ্গার তীরে রাতভর যে অবস্থা চোখে পড়েছে তাতে আহসান মঞ্জিলের মতো ঐতিহাসিক নিদর্শন মানুষ দেখতে গিয়ে আশপাশে চোখ মেলে তাকাতেই চাইবেন না। অথচ এই এলাকাও ইতিহাসের অংশ।
বাংলাদেশ সময়: ০৮২১ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৮, ২০১৫
এসএমএ/এমজেএফ/