লৌহজং (মুন্সীগঞ্জ) থেকে: ‘গরম ভাত; বড় ইলিশ ভাজা; গরম গরম খিচুড়ি; আসেন ভাই; আসেন। ’ এমন হাঁকডাকের বাজারে নিঃসন্দেহে চোখ চলে যায় ইলিশের দিকে! কোথাও ভাজা ইলিশ।
কোথাও কড়াইতে, কোথাও বা ইলিশের কড়াইতে ওঠার অপেক্ষা। আর পথ চলতি মানুষের এই সরগরম যেন বাড়তি ব্যস্ততা এনে দেয় পদ্মাপাড়ের শিমুলিয়া ঘাটে।
এ ঘাটেই খাবার দোকান চালান আকতার হোসেন (২৭)। তবে তার ভাষ্য, ‘হোটেলের মালিকানা আসলে বাবার। সেই অর্থে হোটেলে আছি আমি। ’
মুন্সীগঞ্জের লৌহজং থানার মৌইচ্ছা গ্রামের সিরাজ ছইয়ালের ছেলে আকতার হোসেন। এক যুগের বেশি সময় ধরে জড়িত আছেন হোটেল ব্যবসায়। কালের পরিক্রমায় অর্থাৎ নদী ভাঙনে ঘাটের পরিবর্তন হলেও পরিবর্তন হয় না আকতারদের ভাগ্যের। একইভাবে এক ব্যবসা করে দিনযাপন করছেন তারা।
আলাপে জানা গেল, শুরুটা হোটেল কর্মচারী থেকে। পরে বাবা হোটেল ব্যবসা শুরু করলে সেটার দায়িত্ব নেন। আলাপ জমে গেলে প্রসঙ্গ আসে ইলিশের। আসলে ইলিশটাই যে দোকানের শোভা।
‘না আগের মতো আর ইলিশের বাজার নাই। স্বাদ আর গন্ধটাও নেই পদ্মার সেই ইলিশের। আসলে পদ্মার ইলিশ হলে না গন্ধ থাকবে! ইলিশ তো বেশির ভাগই আসে চাঁদপুর কিংবা বরিশাল থেকে। ’
তিনি জানান, এখানকার মাছের আড়তগুলো থেকেই কিনে বিক্রি করেন তারা। তবে আগে প্রতিটি ইলিশ ভাজি বিক্রি করে তিন থেকে চার’শ টাকা লাভ থাকলেও এখন আড়াই’শ টাকা ওঠানোই চ্যালেঞ্জ। আর ক্রেতাও কমে গেছে।
বাংলানিউজকে আকতার বলেন, এখন ঘাট ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। আগে ১০/১২ হালি বিক্রি হলেও দিন শেষে তিন চার হালি ইলিশ বিক্রিই কঠিন।
গত তের বছরে ঘাট যতবার পরিবর্তিত হয়েছে ততোবারই ভাগ্যে নেমে এসেছে বিপর্যয়। নদীতে ঘাট বিলীন হযে যাওয়ায় জীবনটাই ভেঙে যায়; কিন্তু নদী কী আর আকতারদের বোঝে?
নতুন ঘাট মানেই নতুন সংগ্রাম। এরমধ্যে জায়গা পাওয়া, অসম প্রতিযোগিতা। এক জায়গার স্থাপনা ভেঙে এনে আরেক জায়গায় স্থাপন, কতো ঝামেলা।
‘তার ওপর মহাজনী কায়দায় জায়গার মালিককে মোটা অংকের সেলামি আর দিন শেষে ভাড়া। এসব বাদ দিয়ে আর কতো টাকাই বা লাভ থাকে’ হতাশ কণ্ঠে বলে যান আকতার হোসেন।
মাওয়া থেকে চৌরাস্তা। সর্বশেষ সেখান থেকে শিমুলিয়ার স্পিড বোট ঘাটের প্রবেশমুখের ডান দিকের প্রথম হোটেলটিই আকতারদের।
তবে হোটেলের জায়গা পেতে কম কাঠগড় পোহাতে হয়নি আকতার ও তার বাবার। এনজিও থেকে দুই লাখ টাকা সুদে ঋণ এনে প্রতিদিন সাড়ে সাত’শ টাকা ভাড়া গুনতে হয় তাকে।
আকতার জানান, তার দোকানে আটজন কর্মচারী আছেন। তাদের খাওয়া বাদে জনপ্রতি ৬ হাজার টাকা দিতে হয়। ধর্মঘট কিংবা হরতাল হলে তো কথাই নেই। কোনোভাবেই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার সুযোগ নেই তার। এরপরও ব্যবসাটা করে বেঁচে থাকতে চান তিনি।
জানালেন, তার দুটি ছেলে-মেয়ে আছে। তানিয়া আর সজীব; এরমধ্যে তানিয়া ক্লাস পঞ্চম শ্রেণি আর সজীব পড়ছে তৃতীয় শ্রেণিতে।
‘ভাইরে মানুষ আয়,খায় দায়। কিন্তু কেউ বোঝে না আমাগো কষ্ট। বইল্যা বোঝাইতে পারুম না যে আমরা কত্তো লসে আছি। আমাগো জীবন চলতাছে জুয়া খেলার লাহান’ যোগ করেন আকতার।
শিমুলিয়া ঘাটের হোটেল ব্যবসায়ীরা জানান, খুব বেশি সুবিধা করতে পারছে না তারা। তীব্র প্রতিযোগিতা আর ব্যবসা কমে যাওয়ায় বেশ বিপাকে আছেন এখানকার খুদে ব্যবসায়ীরা।
দিনশেষে জমির মালিককে ভাড়া, সওদা খরচ, কর্মচারী বেতন দিয়ে লাভ খুব একটা থাকে না। এরমধ্যে আছে আবার মহাজন কিংবা এনজিও-এর ঋণ শোধ।
‘আমরা খাবারের হোটেল চালাই। আমাগো বাড়ির হোটেলের (পরিবার) যে কী অবস্থা সে খবর আর কেউ জানে?,’ খানিক ব্যস্ততার ফাঁকে জবাব দিলেন আকতার।
বাংলাদেশ সময়: ২১৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০১, ২০১৫
এমএ
** ‘পরোডা যে বড় হেইডা দ্যাকলেন না’