ঢাকা: বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের নতুন হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা একজন পেশাদার কূটনীতিক। ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিসের (আইএফএস) চৌকস এই কর্মকর্তা ৩০ বছরের দীর্ঘ কূটনীতিক-জীবনে নয়াদিল্লিতে ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিসে এবং প্যারিস, হ্যানয় ও তেল আবিবে ভারতীয় কূটনৈতিক মিশনে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।
এছাড়াও তিনি জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী মিশনে মিনিস্টার/কাউন্সিলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর পাশাপাশি ভিয়েতনামের হো চি মিন সিটিতে এবং দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে কনসাল জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশনারের পদে অভিষিক্ত হবার আগে থাইল্যান্ডে ভারতের হাইকমিশনার হিসেবে এবং ইউএনএসক্যাপ (UNESCAP)-এ ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মি. শ্রিংলা। এরও আগে তিনি ভারতের মিনিস্ট্রি অব এক্সটারনাল অ্যাফেয়ার্সের বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার ও মালদ্বীপ বিষয়ক যুগ্ম-সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়াও মি. শ্রিংলা ওই মন্ত্রণালয়ে জাতিসংঘের পলিটিক্যাল ও সার্ক সংক্রান্ত বিভাগের (SAARC Divisions) নেতৃত্ব দিয়েছেন। উত্তর বিভাগের (নেপাল ও ভূটান) পরিচালক হিসেবে এবং ইউরোপ পশ্চিম (Europe West) বিভাগের উপ-সচিব (Deputy Secretary) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
দিল্লির সেইন্ট স্টিফেন কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন করেন মি. শ্রিংলা। ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিসে যোগ দেবার আগে ভারতের কর্পোরেট ও পাবলিক সেক্টরে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। তিনি নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে মাল্টিলেটারাল ডিপ্লোম্যাসি অ্যান্ড কনফ্লিক্ট প্রিভেনশন বিষয়ে পড়াশুনা করেন। এ বিষয়ে তিনি একটি আন্তর্জাতিক নিবন্ধও (ইন্টারন্যাশনাল পেপার) প্রকাশ করেছেন। এছাড়াও ইকোনমিক ডিপ্লোম্যাসি অ্যান্ড ইন্ডিয়ান ডায়াসপোরা বিষয়েও তার লেখা একাধিক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
মি. শ্রিংলা চলতি ২০১৬ সালের ১৪ জানুয়ারি বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার হিসেবে তার বর্তমান পদে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।
মি. শ্রিংলা ইংরেজি ও ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের ভাষা ছাড়াও ফরাসি, ভিয়েতনামি ও নেপালি ভাষা জানেন। মি. শ্রিংলা মিসেস হেমাল স্টোর শ্রিংলার সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ। তাদের একটি পুত্র সন্তান রয়েছে।
মি. শ্রিংলাকে বাংলাদেশে ভারতের বর্তমান হাইকমিশনার মি. পঙ্কজ শরণের স্থলাভিষিক্ত করায় কূটনৈতিক সংবাদদাতারা কিছুটা অবাকই হয়েছেন। মি. পঙ্কজ শরণের পরবর্তী নিয়োগস্থল রাশিয়ার রাজধানী মস্কো। থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে ভারতের হাইকমিশনার হিসেবে তার তিন বছরের মেয়াদের দু’বছরও পূরণ করেননি শ্রিংলা। গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে হাইকমিশনার হিসেবে নিয়োগের এই সিদ্ধান্তটি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকারের খুবই সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত।
ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিসে মি. হর্ষবর্ধন শ্রিংলার কাজের সাফল্য রীতিমতো ঈর্ষণীয়। অল ইন্ডিয়া সিভিল সার্ভিসের পরীক্ষায় সারা ভারতে তিনি পঞ্চদশ স্থান অধিকার করেন। ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিসকেই নিজের কর্মক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেন তিনি। তাছাড়া বিদেশি ভাষা হিসেবে ফরাসি ভাষাকে পছন্দের শীর্ষে রাখায় এ নিয়ে দু’বার তাঁকে প্যারিসে নিয়োগ দেয়া হয়। মাত্র ২৭ বছর বয়সে কনসাল জেনারেল অব ইন্ডিয়া হিসেবে নিয়োগের সুবাদে সবচেয়ে কম বয়সী ভারতীয় হিসেবে এই পদে নিয়োগ পাওয়াদের একজন হলেন তিনি।
২০০৩ সালে জাতিসংঘে ভারতের সমালোচনা করে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের দেওয়া ভাষণের পাল্টা সমুচিত জবাব দিয়েছিলেন মি. শ্রিংলা। ২০১০-১১ সালে মি. শ্রিংলাকে স্বল্পকালের জন্য মিনিস্ট্রি অব এক্সটারনাল অ্যাফেয়ার্সের ইউএন পলিটিক্যাল ডিভিশনের প্রধান নিয়োগ করা হয়। ওই সময়টায় ভারত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে অস্থায়ী পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিল। ভারত অবশ্য ওই পদে রেকর্ড সংখ্যক সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়। সার্ক বিষয়ক যুগ্ম সচিব হিসেবে মাত্র ৬ মাস দায়িত্ব পালনকালে মি. শ্রিংলা মূল্যবান অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।
বাংলাদেশ ও ভারতের স্থল ও সমুদ্র সীমানা নির্ধারণ বিষয়েও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন মি. শ্রিংলা। এছাড়াও ভারত থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ
হস্তান্তর এবং ২০১০ সালে ১০০ কোটি ডলারের ভারতীয় ঋণচুক্তি বাস্তবায়নেও তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বিষয়ে একজন দক্ষ আলোচক হিসেবে তার সুখ্যাতি রয়েছে। এর ওপর ভিত্তি করেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী দেশে তাকে হাইকমিশনার নিয়োগ করেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তার বাংলাদেশ সফরকালে যেসব চুক্তি স্বাক্ষর করে গেছেন, সেগুলো যাতে যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয় সেটা নিশ্চিত করাও তাকে এ পদে নিয়োগ দেবার পেছনে বড় এক কারণ।
গত ক’বছরে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজসহ বর্তমান রাজনৈতিক নেতাদের অনেকের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন মি. শ্রিংলা তার বর্তমান নিয়োগের পেছনে সুষমা স্বরাজ ও পররাষ্ট্রসচিব এস জয়শঙ্করের পছন্দ ও সুপারিশও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে জানা যায়।
বাংলাদেশের উদ্দেশে রওয়ানা হবার আগে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন মি. শ্রিংলা। বলাবাহুল্য, বাংলাদেশের ব্যাপারে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত আগ্রহ ও উৎসাহ সবার কাছে সুবিদিত। যুগ্ম-সচিব থাকাকালে বাংলাদেশের সঙ্গে উত্তরোত্তর সম্পর্ক উন্নয়নের নানা দিক তিনি প্রায়শই রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কাছে তুলে ধরতেন। এছাড়া একাধিকবার তিনি ভারতীয় রাষ্ট্রপতির সফরসঙ্গী হয়ে বাংলাদেশে এসেছেন।
বাংলাদেশ সময়: ২০৫৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১১, ২০১৫
জেএম/
** বৃহস্পতিবার ঢাকার কর্মস্থলে যোগ দিচ্ছেন শ্রিংলা