তালা(সাতক্ষীরা): এক সময়ের খরস্রোতা শালতা নদী এখন মরা খাল। নদীর দুইপাশে জেগে ওঠা চর যে যার মতো দখল করছে।
এলাকাবাসী বলছেন, শালতা নদী না বাঁচলে লাখ লাখ মানুষ স্থায়ী জলাবদ্ধতায় পড়বে।
বর্ষা মৌসুমে কপোতাক্ষ নদ দিয়ে পানি নিষ্কাশন হয় না। ফলে, তিনটি উপজেলার দশটি ইউনিয়নের অর্ধশতাধিক গ্রামের পানি এ নদী দিয়েই নিষ্কাশন হতো। কিন্তু নদীটি মরা খালে পরিণত হয়েছে। ইতোমধ্যে তালা উপজেলার কাঠবুনিয়া পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেছে। পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা বন্ধ হওয়ায় কয়েক হাজার কৃষক হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন।
সূত্র জানিয়েছে, সাতক্ষীরার তালা উপজেলা, খুলনার পাইকগাছা ও ডুমুরিয়া উপজেলার সীমানা ভাগ হয়ে মাগুরখালী ইউনিয়নের কাঞ্চননগরের ঘ্যাংরাইল নদীতে মিলিত হয়েছে। শালতা নদী থেকে ঘ্যাংরাইল নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ৪০ কিলোমিটার। এই নদীর পাড়ে মোট ৫৩টি গ্রামের প্রায় দুই লাখ ৫০ হাজার মানুষের বসবাস। তীরবর্তী এলাকায় রয়েছে প্রায় ৩০ হাজার হেক্টর ফসলি জমি। এর মধ্যে প্রায় ২০ হাজার হেক্টর জমিতে প্রতি বছর আমন ফসল ফলানো সম্ভব হচ্ছে না।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বর্ষা মৌসুমে কপোতাক্ষ তীরবর্তী এলাকা প্লাবিত হলে পানি নিষ্কাশনের একমাত্র পথ শালতা নদী। কিন্তু শালতা নদীর চিহ্ন মুছে যেতে বসেছে। ডুমুরিয়া উপজেলার গোলাপদাহের চর্তুমোহনা থেকে পূর্বমূখী আমতলী শাখা নদীর মাধ্যমে তেলিগাতী-ঘ্যাংরাইল নদীর সঙ্গে সংযোগ রয়েছে। কাঞ্চননগরের ঘ্যাংরাইল নদী থেকে উজানের কাঠবুনিয়া পর্যন্ত বর্তমান শালতা নদী সীমাবদ্ধ।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, শালতা নদীর উজান অংশে গোলাপদাহ এলাকায় ১৯৭২ সালে বাঁধ দিয়ে নদী শাসন শুরু করা হয়। ফলে পোল্ডার অন্তর্ভুক্ত অংশ মারা গেছে এবং চরভরাটে জায়গায় কালক্রমে জনবসতি, হাট-বাজার গড়ে উঠেছে। পোল্ডারের বাইরে যে জীবিত অংশ বর্তমান তার দু’ধারে ওয়াপদার বাঁধ। এই ওয়াপদার বাঁধের পূর্বপাড়ে ৯টি ও পশ্চিমপাড়ে ৫টি স্লুইচ গেটের মাধ্যমে লোনা পানির মাছ চাষ করা হচ্ছে। যে কারণে কৃষিখাত হুমকির মধ্যে পড়েছে। পোল্ডারের মধ্যবর্তী কিছু বিলে কৃষি জমি থাকলেও সেখানে এখন লোনা পানির মাছ চাষের পায়তারা চলছে।
বুধবার (৬ জানুয়ারি) সকালে শালতা নদীর কাঠবুনিয়াসহ নদী তীরে ঘুরে দেখা যায়, মৎস্য ঘের করার জন্য স্লুইচ গেটগুলো চিংড়ি চাষিরা ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। নদী ভরাটকৃত চরের জমি কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ও দস্যুদের অবৈধ দখলে চলে গেছে। নদীটি এখন মাত্র ৭ থেকে ৮ ফুট চওড়া রয়েছে। নদীতে যে জোয়ার আসে তা লোনা পানির মাছ চাষের জন্য বিলে উঠানো হচ্ছে। স্লুইচ গেটগুলোর বাইরে পলিতে ভরাট হয়ে গেছে।
এতে গেটগুলোর কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। এমনকি অধিকাংশ গেটের ভেতরে ও গেট সংলগ্ন খালে পলি ভরাট হয়ে নিষ্কাশন ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেছে।
শালতা নদী তীরের বাসিন্দা কাঠবুনিয়া এলাকার গণেশ মণ্ডল বাংলানিউজকে বলেন, প্রায় ৪৮ বছর তিনি শালতা নদীতে খেয়া নৌকার মাঝির কাজ করেছেন। দেখেছেন শালতা নদীতে বড় বড় নৌকা, লঞ্চ, কার্গ চলতো। খুলনা থেকে বারোবাড়িয়া হয়ে কপিলমুনি (কপোতাক্ষ) পর্যন্ত লঞ্চ, ইস্টিমার আসতো। শালতা নদীর স্রোত দেখলে ভীষণ ভয় করতো। নৌকায় নদীটি পাড়ি দেওয়া খুবই কষ্টকর ছিল। আজও তিনি ভুলতে পারেনি নদীর সেই স্রোতের কথা।
এলাকাবাসী জানান, বর্তমানে শালতা নদী বাঁচাতে হলে নদীর নিচে খোরেরাবাদ খেয়াঘাট থেকে আরশনগর-চণ্ডীপুর পর্যন্ত (৯ কিমি.), গোলাপদহ থেকে পূর্বমুখি আমতলী নদী ও বাদুরগাছা নদী (১০ কিমি.) পুনঃখনন করে জোয়ার ভাটা চালু করতে হবে। নদীর মধ্যে সব কাঠের ব্রিজ, সাঁকো, বাঁধ অপসারণ এবং নদীকে সব ধরনের দখলমুক্ত করা জরুরি হয়ে পড়েছে। নদী খননের জন্য কোনো মেশিন নয়, ঝুড়ি-কোদালে সাহায্যে তা খননের উদ্যোগ নিতে হবে।
তালার খলিলনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রণব ঘোষ বাবলু বাংলানিউজকে জানান, শালতা নদী সম্পূর্ণ ভরাট হয়ে যাওয়ায় এই জনপদ স্থায়ী জলাবদ্ধতায় রুপান্তিত হচ্ছে। অবিলম্বে শালতা নদী খনন না করলে তালা ও ডুমুরিয়া উপজেলার একটি বৃহৎ অংশ মানুষের বসবাসের অনুপোযোগী হয়ে পড়বে।
তিনি বলেন,‘শালতা নদী খননের দাবিতে খুর দ্রুত গণআন্দোলন গড়ে তোলা হচ্ছে। ’
পাইকগাছা পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. শহিদুল্ল্যাহ মজুমদার বাংলানিউজকে বলেন, নদীর উৎসমুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ওইসব নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে শালতা নদীটি ভরাট হয়ে গেছে। আমাদের কোনো বরাদ্দ না থাকায় কাজ করতে পারিনি। আমরা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে বারবার বিষয়টি নিয়ে দাবি করলেও তারা কোনো কর্ণপাত করেনি।
তালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা(ইউএনও) মো. মাহাবুবুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন,‘আমি শালতা নদীর বিষয়টি নিয়ে ওপরে আলাপ করবো। কারণ নদীটি আমার সীমান্তবর্তী। সবার সঙ্গে আলাপ করে খননের ব্যবস্থা করা হবে। ’
সাতক্ষীরা-১ (তালা-কলারোয়া) আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মোস্তফা লূৎফুল্লাহ বাংলানিউজকে বলেন,‘শালতা নদী নিয়ে তিনি সংসদে উত্থাপন করেছি। পানিসম্পদ মন্ত্রীর কাছে ডিও লিটার দিয়েছি। চলতি বছরের বরাদ্দে এটি ডিপিপি পাস হয়েছে। তবে, শালতা না বাঁচলে এই এলাকা স্থায়ী জলাবদ্ধতার কবলে পড়বে।
খুলনার ডুমুরিয়া সংসদ সদস্য ও মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ বাংলানিউজকে জানান, শালতা নদী খননের ব্যাপারে সবাইকে একত্রিত হয়ে উদ্যোগ নিয়ে খনন করতে হবে। তিনি বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে আলোচনা করবেন বলে জানান।
বাংলাদেশ সময়: ০১৩০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০১৬
পিসি