ময়মনসিংহ: বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) ময়মনসিংহ আঞ্চলিক কার্যালয়। একটি ছোট পিকআপের মালিকানা বদলের কাগজ করতে এখানে এসেছেন মুকুল আহমেদ নামে বেসরকারি এক প্রতিষ্ঠানের চাকুরে।
কাজের ধরন বুঝে ওই ব্যক্তিকে বারান্দায় দাঁড় করিয়েই ভেতরে প্রবেশ করলেন সিরাজুল নামে এক দালাল। মিনিট পাঁচেক পর ঘুরে এসে জানালেন ১২ হাজার টাকা দিলেই কাজ হয়ে যাবে। সময় লাগবে সপ্তাহখানেক। বনিবনা না হওয়ায় এবার ওই পিকআপ মালিক নিজেই ঢুকলেন অফিসের ভেতর।
কথা বললেন, কম্পিউটার অপারেটর হারুনের সঙ্গে। তিনি জানালেন, মালিকানা বদলের কাগজ করতে ৬ হাজার টাকা খরচা করলেই হবে।
ঘটনাটি মঙ্গলবার (১২ জানুয়ারি) বেলা সাড়ে ১১টার। এখানেই শেষ নয়। ওই একই ব্যক্তি এবার পাশের কক্ষে উচ্চমান সহকারী আব্দুল মতিনের টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। কিছুক্ষণ আগে দালাল সিরাজুল তার সঙ্গে কথা বলেই না-কি ১২ হাজার টাকায় দফারফা করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
মতিনের টেবিলের সামনে থাকা ট্রাক চালক অজিত (৩৫) ফাঁস করে দিলেন এ গোমর। এরপর ক্ষোভ নিয়ে জানান, ৬ মাস ঘুরে ড্রাইভিং লাইসেন্স পেয়েছেন। এজন্য অতিরিক্ত টাকাও গুণতে হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলেই হনহন করে কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলেন মতিন। খানিক সময় পর অফিসের সামনের গাছতলায় এবার সেই সিরাজুলকেই দেখা গেলো টুপি-দাড়িওয়ালা এক মক্কেলকে লাইসেন্স করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিতে।
ময়মনসিংহ ও নেত্রকোণা জেলা নিয়ে গঠিত ময়মনসিংহ বিআরটিএ অফিসের আঞ্চলিক কার্যালয়ে এখন দালাল সিন্ডিকেটের দাপট ও ঘুষ বাণিজ্যের বিষয় ওপেন সিক্রেট। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ঠিক নিচের এ অফিসটিতে তদবির ও ঘুষ ছাড়া কোনো কাজই হয় না। অফিসের সহকারী পরিচালক জালাল উদ্দিনের বিরুদ্ধেও রয়েছে বাণিজ্যের নানা অভিযোগ।
এ অফিস থেকে মাত্র ১০ গজ দূরের চা-পানের দোকানদার শাহাবুদ্দিন (৪০) মৃদু হেসে জানান, এখানে প্রকাশ্যে নয়, এখন নীরবেই ঘুষের লেনদেন হয়। অফিসের পিয়ন থেকে বড় কর্তা, সবাইকে ম্যানেজ করেই চলে এমন রমরমা কারবার। দেখার নেই কেউই।
জানা যায়, বিভিন্ন যানবাহনের লাইসেন্স, ড্রাইভিং লাইসেন্স, নবায়ন, রেজিস্ট্রেশন, মালিকানা বদল, ফিটনেস ও রুট পারমিটসহ নানা কাজে এ বিআরটিএ অফিসে আসতে হয় যানবাহন মালিক ও চালকদের। আর এ সুযোগকে কাজে লাগিয়েই দীর্ঘদিন ধরে এখানে ঘাঁটি গেড়ে বসেছে দালাল সিন্ডিকেট। এ অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও নানা অযুহাতে কামিয়ে নিচ্ছেন নগদ অর্থকড়ি।
স্থানীয় ভুক্তভোগীরা জানান, এ অফিসে রুট পারমিট নিতে দেড় হাজার টাকা খরচা করতে হয়। আর মালিকানা বদল, মোটর সাইকেল রেজিস্ট্রেশন, ফিটনেস ও সিএনজি অটোরিকশার রেজিস্ট্রেশনের জন্য ‘নির্ধারিত’ হরেক রেইট। অতিরিক্ত খরচাপাতি করলে পরিদর্শন ছাড়াই বাস-মিনিবাসের ফিটনেস সার্টিফিকেটও মেলে।
এ অফিসেরই দেয়ালে সাইনবোর্ডে সাঁটানো রয়েছে, ‘অনুগ্রহপূর্বক বহিরাগত দালালদের দ্বারা প্রতারিত হবেন না। যেকোনো প্রয়োজনে অফিসে কর্মরতদের সাথে যোগাযোগ করুন। ’ অথচ বাস্তবতা ঠিক বিপরীত।
খোদ অফিসের কর্তা-ব্যক্তিদের সঙ্গেই রয়েছে দালালদের বিশেষ সম্পর্ক। নিয়ম মেনে কেউ এ অফিসে এসে নিজেদের কাজ সারতে চাইলে রীতিমতো হয়রানির মুখে পড়তে হয়, এমন অভিযোগও ভুক্তভোগীদের।
১২ ও ১৩ জানুয়ারি সকালে-বিকেলে সরেজমিনে এ অফিসে গিয়ে দেখা গেলো, এ অফিসের ভেতরের স্টোর রুমেই চেয়ারে বসে আছেন সাদ্দাম নামে এক তরুণ। তিনি অফিসের উচ্চমান সহকারী মতিনের ভাতিজা। দালালি করাই তার কাজ।
হঠাৎ অফিস থেকে বেরুতেই কথা হয় সাদ্দামের সঙ্গে। আপনি কী পদে চাকরি করেন, জানতে চাইলে বলেন, ‘চাচাকে (মতিন) সাহায্য করতেই এখানে আসি। ’
স্থানীয়দের অভিযোগ, এ অফিসের আশপাশে সকাল থেকে বিকেল নাগাদ ঘুরঘুর করতে দেখা যায় দালাল সিন্ডিকেটের সদস্যদের। কামাল নামে একজনকে ঘিরে মঙ্গলবার (১২ জানুয়ারি) সকালে দাঁড়িয়ে আছেন বেশ কয়েকজন দালাল। কামাল এ অফিসে চাকরি করেন কি-না, জানতে চাইলে সাদ্দাম জানান, ‘তিনি এডি স্যারের লোক। ’
এ অফিসটিকে ঘিরে দালাল সিন্ডিকেটের দাপট নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন মোটর সাইকেলের লাইসেন্স করতে আসা মাঈন উদ্দিন নামে এক ব্যক্তি। থাকেন সদর উপজেলার শম্ভুগঞ্জে। এক দালালের কাছে ইতোমধ্যেই দেড় হাজার টাকা ধরা খেয়েছেন। এরপর নিজেই অফিসে কিছু টাকা খরচাপাতি করে বুধবার (১৩ জানুয়ারি) বিকেলে লাইসেন্স পেয়েছেন।
এ বিষয়ে ময়মনসিংহ বিআরটিএ’র সহকারী পরিচালক এ.টি.এম জালাল উদ্দিনের বক্তব্য জানতে অফিসে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। ওইদিন সন্ধ্যায় দু’দফায় বেশ কয়েকবার মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি সাড়া দেননি।
বাংলাদেশ সময়: ১১০৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০১৬
এমএএম/জেডএস/জেডএম