ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

৫ টাকার জন্য ক্ষতি ৭০ কোটি টাকার!

মাসুক হৃদয়, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৫২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৭, ২০১৬
৫ টাকার জন্য ক্ষতি ৭০ কোটি টাকার! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ব্রাহ্মণবাড়িয়া: ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সোমবারের (১১ জানুয়ারি) সংঘর্ষ ও মঙ্গলবার রেল স্টেশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় অন্তত ৭০ কোটি টাকার সম্পদের ক্ষতি হয়েছে।
 
এ তাণ্ডবের সূত্রপাত হয়েছিল পাঁচ টাকা কম ভাড়া দেওয়া নিয়ে এক মাদ্রাসা ছাত্র ও ইজিবাইক চালকের মধ্যে বচসার জের ধরে।


 
বুধবার (১৩ জানুয়ারি) জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মাত্র পাঁচ টাকার জন্য ৭০ কোটি টাকার সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির তথ্য প্রকাশ করা হয়।
 
১১ জানুয়ারি, সোমবার বিকেল সাড়ে ৪টার ঘটনা। ঘটনাস্থল ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের টিএ রোডের জেলা পরিষদ মার্কেট সংলগ্ন সড়ক। পাঁচ টাকা ভাড়া কম দেওয়া নিয়ে ব্যাটারি চালিত ইজিবাইকের এক চালকের সঙ্গে দুই মাদ্রাসা ছাত্রের বাকবিতণ্ডা চলছিল। একপর্যায়ে মাদ্রাসা ছাত্রদের একজন ইজিবাইক চালককে মারতে উদ্যত হন।

এ ঘটনা দেখে পাশের বিজয় টেলিকম নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সত্ত্বাধিকারী রনি আহমেদ এগিয়ে এসে দুই ছাত্রের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় লিপ্ত হন। একপর্যায়ে এক মাদ্রাসা ছাত্রকে থাপ্পড় দেন রনি। এ সময় মোশাররফ নামে ওই মাদ্রাসা ছাত্র নিজেকে কওমি ছাত্র ঐক্য পরিষদের সেক্রেটারি পরিচয় দিয়ে রনিকে দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।  
 
এ তুচ্ছ ঘটনার সূত্র ধরেই দুই ঘণ্টা পর শতাধিক মাদ্রাসা ছাত্র বিজয় টেলিকমে হামলা চালায়। তারা রনি ও তার চাচাতো ভাই ইউসুফকে মারধর করে এবং দোকান ভাঙচুর ও মালপত্র লুট করে।
 
এর জের ধরে রনির বাড়ি পৌর এলাকার শিমরাইলকান্দি থেকে একদল যুবক লাঠিসোটা নিয়ে সন্ধ্যা পৌনে সাতটার দিকে কান্দিপাড়া মাদ্রাসা রোডে এসে হৈ-হুল্লোড় করতে থাকেন। একপর্যায়ে মাদ্রাসার ছাত্ররা রাস্তায় নেমে এলে শিমরাইলকান্দির যু্বকদের সঙ্গে সংঘর্ষ বেধে যায়। উভয়পক্ষই ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকে। এরই মধ্যে রনির আত্মীয় জেলা ছাত্রলীগের এক সহ সভাপতির নেতৃত্বে ২০/৩০ যুবক এসে মাদ্রাসা ছাত্রদের ধাওয়া করে। শুরু হয় তুমুল সংঘর্ষ। এ সময় বিকট শব্দে বেশ কয়েকটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটে। রণক্ষেত্রে পরিণত হয় কান্দিপাড়া মাদ্রাসা রোড, মুহুর্মুহু ককটেলের বিস্ফোরণে প্রকম্পিত হয় গোটা শহর।

এরপর উভয়পক্ষকে থামাতে পুলিশ এলে মাদ্রাসা ছাত্ররা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকে। পুলিশও পাল্টা টিয়ার শেল, রাবার বুলেট ছোড়ে। এরই মধ্যে কয়েক দফা সংঘর্ষ চলে। সন্ধ্যা সাতটা থেকে শুরু হওয়া ত্রিমুখী সংঘর্ষ চলে রাত ১১টা পর্যন্ত।

প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন উৎসুক জনতার মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় ধারণকৃত ভিডিও চিত্র ও তাদের বক্তব্য থেকে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।
 
সোমবার রাতের ঘটনায় ১৮ জন পুলিশ সদস্যসহ অন্তত ৪০ জন আহত হয়। আহতদের মধ্যে মাসুদুর রহমান (২০) নামে এক মাদ্রাসা ছাত্র মঙ্গলবার ভোরে মারা যান। মাদ্রাসা ছাত্র নিহত হওয়ার জের ধরে মঙ্গলবার সকাল থেকেই বিক্ষোভ শুরু করে মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকরা।

সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তারা শহরের রেলগেট এলাকায় রেললাইনে গাছের গুঁড়ি ফেলে আগুন ধরিয়ে রেললাইন অবরোধ করে। একপর্যায়ে মাদ্রাসা ছাত্ররা রেললাইন উপড়ে ফেলে। এর কিছুক্ষণ পর একদল মাদ্রাসা ছাত্র মিছিল নিয়ে রেলস্টেশনে ঢুকে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। তারা রেলস্টেশনটি সম্পূর্ণ গুঁড়িয়ে দেয় ও মূল্যবান মালপত্র বাইরে রেললাইনের কয়েকটি স্থানে স্তুপ করে তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়।

এছাড়া টিকিট কাউন্টার, স্টেশন মাস্টার ও সহকারী স্টেশন মাস্টারের কক্ষ, তিনটি বিশ্র্রামাগার, পার্সেল রুম, কম্পিউটার রুম ও টয়লেটে অগ্নিসংযোগ করে। এতে সহকারী স্টেশন মাস্টারের কক্ষে থাকা সিগন্যালিং প্যানেল বোর্ড, টিকিট কাউন্টারে থাকা বড় দু’টি ডাটাবেজ সার্ভার, জেনারেটর, চারটি কম্পিউটার মনিটর, প্রিন্টার, পাওয়ার সাপ্লাই, কাগজপত্র, সোফাসহ সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
 
রেলস্টেশনের প্রায় আড়াই কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেছেন রেলওয়ের কর্মকর্তারা। যা কাটিয়ে উঠতে দীর্ঘদিন সময় লাগবে বলেও জানান তারা।
 
হামলাকারীরা স্টেশন প্লাটফর্মে থাকা আটটি ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা গুড়িয়ে দেয় ও যাত্রীদের বসার আসন পুড়িয়ে দেয়। রেললাইন মেরামত কাজে ব্যবহৃত ট্রলিগুলোও পুড়িয়ে দেয় তারা। সাড়ে তিন লাখ টাকার দু’টি বড় ডাটাবেজ সার্ভার পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এছাড়া তারা দরজা-জানালেও ভেঙে ফেলে।
 
স্টেশন মাস্টার মহিদুর রহমান জানান, সিগন্যালিং প্যানেল বোর্ডটির দাম আনুমানিক অর্ধকোটি টাকা। এটির সাহায্যে ট্রেন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হতো।
 
শুধু রেলস্টেশনেই নয়, আরেক দল মাদ্রাসা ছাত্র একই সময়ে শহরের পুরাতন জেল রোডে অবস্থিত বিশ্ববরেণ্য সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতাঙ্গনে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে। সংগীতাঙ্গনের মিউজিয়ামসহ প্রতিটি কক্ষের সবকিছু পুড়িয়ে দেয়। এখন ভবনটি ছাড়া ওই সংগীতাঙ্গনে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।
 
এতে কোটি টাকার ক্ষতির পাশাপাশি সুর সম্রাটের সব স্মৃতি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। যা পূরণ করা সম্ভব নয়।
 
হামলাকারীদের হাত থেকে রেহাই পায়নি জেলা শিল্পকলা একাডেমি, শহীদ ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত ভাষা চত্বরের সাহিত্য একাডেমি, তিতাস সাহিত্য সংস্কৃতি পরিষদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া শিশু নাট্যম, শহীদ ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত স্মৃতি পাঠাগার, তিতাস ললিতকলা একাডেমি, ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কুল ভবন, প্রশিকা কার্যালয় ও জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়।
 
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল-মামুন সরকারের দাবি, মাদ্রাসা ছাত্রদের সঙ্গে বিএনপি অধ্যুষিত কান্দিপাড়া মহল্লার কর্মী ও জামায়াত-শিবির কর্মীরা মিশে শহরজুড়ে এ তাণ্ডব চালিয়েছে। তাদের এ তাণ্ডবে প্রায় ৭০ কোটি টাকার সম্পদের ক্ষতি হয়েছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আহ্বায়ক আবদুন নূর জানান, মৌলবাদী এ চক্রটি বেছে বেছে সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে হামলা করেছে। তারা চায় সংস্কৃতির রাজধানী খ্যাত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাংস্কৃতিক কার্যক্রম স্তব্ধ করে দিতে। তারা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার যে ক্ষতিসাধন করেছে তা কোনোদিনও পুরণ হবার নয়।

তিতাস সাহিত্য সংস্কৃতি পরিষদের পরিচালক মনির হোসেন বলেন, সুরের শহরে অসুরেরা হামলা করে দেশ-জাতির কাছে নিজেদের নষ্ট চরিত্রের বলে জানান দিয়েছে। তারা জাতীয় সম্পদ নষ্ট করে প্রমাণ দিয়েছে তারা এখনো পাকিস্তানি ভাবাদর্শে বিশ্বাস করে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর ও আখাউড়া রেলওয়ে থানা সূত্র জানায়, এসব তাণ্ডবের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে পৃথক ১১টি মামলা রুজু করা হয়েছে। মামলায় সাত হাজার ৫৯৪ জনকে আসামি করা হয়।

এছাড়া শনিবার সকালে মাদ্রাসা ছাত্র মাসুদুর রহমান হত্যা ঘটনায় মাদ্রাসার শিক্ষা সচিব মুফতি শামসুল হক বাদী হয়ে অজ্ঞাত ৫শ’ জনকে আসামি করে সদর থানায় মামলা দায়ের করেন।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৭, ২০১৬
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।