ঢাকা: আলোচিত ব্যবসায়ী মুসা বিন শমসের তার অর্থের বিষয়ে কোনো ভুল তথ্য দিলে আইনি ব্যবস্থা নেবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ ক্ষেত্রে কোনো রকম ছাড় দেওয়া হবে না বলে রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি দমন সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (২৮ জানুয়ারি) টানা দেড়ঘণ্টা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। এ জিজ্ঞাসাবাদে তিনি দুদককে আবারও বলেছেন, সুইস ব্যাংকে তার ১২ বিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশি প্রায় ৯৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা, প্রতি ডলার ৭৮ টাকা হিসেবে) জব্দ অবস্থায় রয়েছে। যা তিনি এর আগে সম্পদ বিবরণীতে উল্লেখ করেছেন।
জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বের হয়ে এসে মুসা সাংবাদিকদের সামনেও বলেছেন, ১২ বিলিয়ন ডলারের তথ্য সত্য। এ অর্থ পেতে তিনি আইনি লড়াইয়ে জয়ী হবেন বলেও জানান।
গণমাধ্যমের সঙ্গে মুসা কথা বলার পর দুদক কমিশনার মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর কাছে সাংবাদিকরা মুসার রহস্যে ভরা অর্থের বিষয়ে জানতে চান।
দুদকের এ কমিশনার বলেন, ‘কয়েক দিনের মধ্যেই আমরা মুসার সুইস ব্যাংকের ওই অ্যাকাউন্টের তথ্য পাবো। জিজ্ঞাসাবাদে মুসা জানিয়েছেন, তার পার্টনার কিছুদিনের মধ্যেই ওই অ্যাকাউন্টের কাগজপত্র দেশে পাঠিয়ে দেবে। এরপর মুসা তা কমিশনে সরবরাহ করবে’।
তিনি বলেন, ‘গুলশান ও বনানীতে দু’টি বাড়ি ছাড়া সাভার ও গাজীপুরে এক হাজার ২০০ বিঘা জমির বিষয়ে মুসা দুদককে জানিয়েছেন যে, আইনজীবী এসব দেখাশোনা করতেন তিনি মারা গেছেন। অল্পদিনের মধ্যেই ওইসব জমির কাগজপত্র কমিশনে দাখিল করবেন’।
দুদকের অনুসন্ধানে মুসা অসহযোগিতা করেছেন মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, ‘কমিশনের অনুসন্ধানে মুসা অসহযোগিতা করেছেন। এ কারণে অনুসন্ধান শেষ করতে সময় লাগছে। তবে অনুসন্ধানে বেশ অগ্রগতি হয়েছে। এখন আর তেমন সময় লাগবে না’।
‘মুসার জমা দেওয়া সম্পদের হিসাবে গড়মিল মনে হয়েছে’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
দুদকের অন্যতম প্রধান এ নির্বাহী আরও বলেন, ‘অনুসন্ধানে তার দেওয়া কোনো তথ্য ভুল প্রমাণিত হলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে’।
এর আগে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে মুসা দুপুরে সাংবাদিকদের সুইস ব্যাংকে তার ১২ বিলিয়ন ডলার জব্দ অবস্থায় রয়েছে বলে জানিয়েছেন। কেন জব্দ অবস্থায় রয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ইরেগুলার ট্রানজেকশনের কারণে জব্দ হয়েছে’।
এ টাকা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে মুসা বলেন, ‘এটা একটা বিচারাধীন বিষয়। আমি বাদী হয়ে মামলা করেছি। বিচারাধীন যেকোনো বিষয়ে কথা বলা অবৈধ। আমি মামলায় জয়ী হওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী। এ বিষয়ে দুদককে আমি সব তথ্য দিয়েছি’।
১২ বিলিয়ন ডলার কি দেশ থেকে পাচার কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন ‘আমি ধোলাইখাল থেকে পানি নিয়ে আটলান্টিক মহাসাগর গড়িনি। আর বাংলাদেশ থেকে হুন্ডি করে বিদেশে এতো টাকা জমানো সম্ভব নয়। পৃথিবীর ৪০টি দেশের সঙ্গে আমার ব্যবসা, ৪০ দেশের সেনাবাহিনীর সঙ্গে আমার ব্যবসা। সেসব দেশের সঙ্গে যতো বিল সেটেল হয়েছে তা সুইস ব্যাংকে ট্রান্সফার হয়েছে। বরং আমার কোম্পানির মাধ্যমে (জনশক্তি রফতানি প্রতিষ্ঠান ড্যাটকো) শত শত কোটি টাকা দেশে এনেছি’।
২০১৫ সালের ৭ জুন দুদকে দেওয়া সম্পদ বিবরণী অনুযায়ী সুইস ব্যাংকে মুসা বিন শমসেরের ১২ বিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৯৩ হাজার ছয় শ কোটি টাকা), ‘ফ্রিজ’ অবস্থায় রয়েছে। এ ছাড়াও সুইস ব্যাংকের ভল্টে ৯০ মিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশি প্রায় সাতশ’ কোটি টাকা) দামের অলঙ্কার জমা রয়েছে।
গাজীপুর ও সাভারে তার নামে প্রায় এক হাজার দুইশ’ বিঘা সম্পত্তি রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন মুসা। বর্তমান বাজার দরে এসব জমির মূল্য এক হাজার দুইশ’ কোটি টাকারও বেশি। অধিকাংশ সময় দেশের বাইরে থাকায় এসব সম্পত্তির খাজনা পরিশোধ করে নামজারি করা সম্ভব হয়নি বলেও জানান মুসা।
বিপুল পরিমাণ সম্পদের রহস্য উদ্ঘাটন করতে গত ৪ জানুয়ারি তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলবি নোটিশ পাঠায় দুদক। পরিচালক মীর জয়নুল আবেদীন শিবলী স্বাক্ষরিত ওই তলবি নোটিশে তাকে ১৩ জানুয়ারি বেলা ১১টায় সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়ে হাজির হতে বলা হয়েছিল। কিন্তু অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে গত ১২ জানুয়ারি দুদকের তলবে হাজির হতে পারছেন না বলে মুসা বিন শমসের যে চিঠি পাঠান। তাতে বলা হয়, তিনি ‘মৃত্যু আতঙ্কে (ডেথ ফোবিয়া)’ ভুগছেন। এজন্য তিনি দুদকের কাছে জিজ্ঞাসাবাদের সময় তিনমাস পেছাতে আবেদন জানান।
তার এ আবেদন আমলে না নিয়ে দুদক তাকে ২৮ জানুয়ারি জিজ্ঞাসাবাদে হাজির হওয়ার দিনক্ষণ বেধে দেয়।
বৃহস্পতিবার এ অসুস্থতার বিষয়ে জানতে চাইলে মুসা বিন শমসের সাংবাদিকদের বলেন, ‘ডেথ ফোবিয়া হচ্ছে ভয়ঙ্কর মানসিক রোগ। যখন ওই দুর্ঘটনা (সুইস ব্যাংকের টাকা ফ্রিজ করা) হলো তখন থেকে আমি এ রোগে ভুগছি। মাঝখানে শরীরের অবস্থা আরও খারাপ ছিল, এখন একটু ভালো’।
বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন দুদকের পরিচালক মীর মো: জয়নুল আবেদীন শিবলী। এরপর বাইরে এসে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন মুসা।
আপাদমস্তক মূল্যবান অলঙ্কারে সজ্জিত হয়ে নারী দেহরক্ষীসহ প্রায় অর্ধশত ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষীর বাহিনী নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে এলেও দুদকের ভেতরে একাই প্রবেশ করতে হয়েছে মুসা বিন শমসেরকে। তার সঙ্গে থাকা কয়েকজন ভেতরে প্রবেশ করতে চাইলেও দুদকের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা ঢুকতে দেননি। তবে বের হয়ে সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার সময় মুসার কয়েকজন সহকারী তার পাশে এসে দাঁড়ান।
সুসজ্জিতভাবেই সাদা রঙের মারসিডিস বেঞ্জে চড়ে রাজকীয় কায়দায় দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে আসেন মুসা বিন শমসের। দুদকে প্রবেশ করার আগে তার সামনে ও পেছনে একডজন গাড়ি দেখা গেছে। ৬ জন নারী দেহরক্ষীসহ প্রায় ৫০ জনের ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী ও কর্মকর্তা নিয়ে দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে তিনি আসেন। ভেতরে মুসার জিজ্ঞাসাবাদ চলাকালে বাইরে তার নিরাপত্তা কর্মীদের ওয়াকিটকি হাতে ব্যস্ততা দেখা গেছে।
২০১৪ সালের শেষের দিকে মুসার সম্পদের অনুসন্ধানে নামে দুদক। ১৮ ডিসেম্বর প্রথম তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। ওই জিজ্ঞাসাবাদেও তিনি এবারের মতো হীরার জুতা থেকে শুরু করে আপাদমস্তক মূল্যবান অলঙ্কারে সজ্জিত হয়ে জিজ্ঞাসাবাদে হাজির হন। সঙ্গে ছিল নারী-পুরুষের অর্ধশতাধিক দেহরক্ষীর বহর।
বাংলাদেশ সময়: ২১০০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৮, ২০১৪
এডিএ/এএসআর
** ‘একাত্তরে পাকিস্তানি আর্মিদের কাছে বন্দি ছিলাম’
** একা দুদকে মুসা বিন শমসের, মূল ফটকে নিরাপত্তাবহর!
** দুদকে মুসা বিন শমসের, চলছে জিজ্ঞাসাবাদ