হাতিয়া (নোয়াখালী) থেকে: টানা ১৪ ঘণ্টা জলপথ পাড়ি শেষে সকাল সাড়ে ৭টায় এম ভি ফারহান-৪ তার সুঢৌল পেট আলতো করে ঠেকায় হাতিয়া লঞ্চঘাটের ভাসমান পন্টুনে। সাথে সাথে ২০২ নম্বর কেবিনের জানলা ফুঁড়ে যে সকালটা ভেতরে প্রবেশ করল, তাকে পাখির মত সকাল-ই বলা চলে!
কারণ, একটি নয়, দু’টি নয়, তিন তিনটি পাখি কাঁচের জানালা দিয়ে উকি মারছে।
পূর্ব আকাশে লাল টকটকে সূর্য। জানালার সামনে তিন তিনটি পাখি। বিশুদ্ধ সকালের এমন অপরূপ রূপ অনেক দিন পর দেখা।
কেবিনের দরজা খোলার সাথে সাথে ভোরের পাখি সাইফুলের বিনম্র প্রশ্ন-‘স্যার ব্যাগ আছে, লওন লাগব’।
ব্যাগ একটা আছে বটে; কিন্তু বহন করার জন্য ফুটফুটে সুন্দর এই ভোরের পাখিটাকে আমার প্রয়োজন নেই। পাশে দাঁড়ানো সুমন-সাইফুল নামে অন্য দুই ভোরের পাখি দিয়েও বহন করাতে চাই না।
আবার কাকডাকা ভোরে তীব্র শীত উপেক্ষা করে লঞ্চঘাটে এসে দাঁড়িয়ে থাকা পাখি তিনটিকে খালি হাতে ফেরানোও কঠিন। তাই ব্যাগের পরিবর্তে গল্প জুড়ি ওদের সাথে।
তাদের বয়স দশ বছরের মধ্যেই হবে। প্রতিদিন সূর্য ওঠার আগেই হাতিয়া লঞ্চঘাটে এসে হাজির হয়। ওদের শরীরের ওজনের সমান ব্যাগগুলো লঞ্চ থেকে নামিয়ে ২০/৪০ টাকা আয় করে। কিন্তু সমস্যা হল-এত ছোট বাচ্চার হাতে মূল্যবান মালামাল তুলে দিতে সাহস পান না শহর থেকে আসা ‘অসাধারণ’ মানুষগুলো। সাইফুল-রবীন-সুমনদের পেটের ক্ষুধার চেয়ে শহুরে মানুষের ব্যাগের মূল্য যে অনেক বেশি।
টাকা দিয়ে কী কর?-রবীনের সরল উত্তর, ‘মাকে দেই’। সাইফুল অব্শ্য বাবার হাতে তুলে দেয় তার টাকা। কারণ, তার বাবাও এই লঞ্চঘাটে কুলির কাজ করে।
আর সুমনের টাকা কাউকে দিতে হয় না। সে নিজেই জমিয়ে রাখছে। বড় হলে মোটর সাইকেল কিনে যাত্রী টেনে অনেক টাকা আয় করার লক্ষ্য তার।
ওদের মহামূল্যবান ১৫ মিনিট সময় নষ্ট করে ৩ জনের হাতে ৩০ টাকা ধরিয়ে দিলাম। তিন জনের মুখেই তখন মুক্তদানার মত হাঁসি। যে হাসি একবার দেখলে বাকি জীবন আর কোনো হাসি না দেখলেও চলে। এতো অল্পতে যারা এত খুশি,দারিদ্র্য তাদের মনে নয়, হতে পারে বহিরাবরণে!
রবীনদের সাথে কথা শেষ করে ব্যাগ-পেট্টা নিয়ে লঞ্চ থেকে নামতেই এ রকম আরো অনেক ভোরের পাখির সাথে দেখা। যারা প্রতিদিন এই সময়টা থেকে আসা লঞ্চযাত্রীদের মাল-পত্র নামিয়ে দেয়।
আবার বেলা সাড়ে ১২টায় ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া এই লঞ্চের যাত্রীদের মাল-পত্র লঞ্চে তুলে দিয়ে ঘরে ফেরে।
বাংলাদেশের অনগ্রসর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার এসব ভোরের পাখি শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। সুমন-রবীন-সাইফুলদের সাথে কথা বলে জানা গেল, ওদের কেউ স্কুলে যায় না।
দরিদ্র পিতার পেশাকেই ওরা নিজেদের পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে। তবে কারো কারো স্বপ্ন বড় হয়ে মোটর সাইকেল কিনে তাতে যাত্রী বহন করে অনেক টাকা আয় করবে। ওদের স্বপ্ন এর চেয়ে বেশিদূর বিস্তৃত হতে চায় না যেন!
বাংলাদেশ সময়: ১০৫২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৭, ২০১৬
এজেড/জেডএম