লালপুর (নাটোর) থেকে: ফকির চাঁন গোঁসাইজির আশ্রমের বাইরের ফটকের আগেই হাতের ডানে তিনটি পুকুর। ফটক পেরিয়ে ডানে গোশালা, অফিস ঘর ও জনৈক ভক্তের সমাধি।
মূল ফটক পেরিয়ে জুতা খুলে প্রবেশ আশ্রমে। ডানে অতিথিশালা, রসুঁইঘর, মাঝে উঠান। উঠান পেরিয়ে নাক বরাবর একটি কুয়া। নাম জিয়াদ কুণ্ড। মানে জীবনদানকারী। কুয়ার ঠিক আগে বাঁপাশে ফকির চাঁন গোঁসাই’র সমাধি মঠ।
সমাধির পাশঘেঁষে আরও কয়েকটি ছোট বড় মঠ। মঠগুলোর সীমানা যেখানে শেষ সেখানে প্রাচীরের দরজা। দরজা পেরিয়ে বাইরে ডানে তাকালেই একটি বটগাছ। অক্ষয় বট নামেই এর পরিচিতি।
গল্পটা শুরু করা যাক কুয়া দিয়ে। প্রায় ৩শ’ বছর আগে ফকির চাঁন গোঁসাই এখানে আস্তানা গাঁড়েন। তারও আগে থেকে ছিলো এ কুয়াটি। কুয়ার একপাশ দিয়ে সোজা উঠে গেছে সিঁড়ি। সিঁড়িটি সংযুক্ত রসুঁইঘরের সঙ্গে। ভরপেটে সেখানে যাওয়ার অনুমতি নেই। সকালে প্রয়োজনীয় পানি সংগ্রহ করা হয়। কথাগুলো একনাগাড়ে বলে যাচ্ছিলেন আশ্রমের বর্তমান সাধু সদানন্দ। জ্বর গায়ে কম্বল জড়িয়ে কথা বলছিলেন তিনি।
জানালেন, এই কুয়ায় জোয়ার-ভাটা খেলে। তাই সিঁড়ি করা আছে। স্থাপনাগুলো বয়সের ভারে ন্যুব্জ। ২শ’ থেকে ৩শ’ বছরের। তাই সংস্কার করে পরিবর্তন করা হয়েছে কিছুটা।
তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই কুয়ার পানি জীবনদানকারী। তাই নাম জিয়াদ কুণ্ড। অমৃতও বলা হয় এর পানিকে। রোগ-ব্যাধি নিরাময়ে দারুণ কার্যকর। আশ্রমের বড় সব অনুষ্ঠানের প্রসাদও তৈরি হয় এই পানিতে। এর পানি কখনো একেবারে শুকায় না। দুটি শ্যালো মেশিন লাগিয়েও এর পানি শুকানো যায়নি।
কুয়াতে বড় বড় মাছও হয়। তবে সেই মাছ খাওয়া যায় না। বৈষ্ণবরা সাধারণভাবেই নিরামিষভোজী। তবে যারা এই কুয়ার মাছ খেতে গেছেন তারা সম্মুখীন হয়েছেন এক বিচিত্র অভিজ্ঞতার। কারণ এই কুয়ার কোনো মাছ সিদ্ধ হয় না। এটা জানার পর থেকে কুয়ার মাছ বড় হয়ে মারা গিয়ে ভেসে উঠলে সমাধি দেওয়া হয়। বর্তমানে ধুলোময়লা থেকে রক্ষা পেতে কিছুটা উঁচু করে গেঁথে দেওয়া হয়েছে। কুয়ার সঙ্গে লিংক করে দেওয়া তৈরি করা আছে আরও একটি ছোট্ট কুয়া। এটা শুধু ভক্তদের পানি পানের জন্য। তবে পানি থাকলেও এখন এটি খাওয়ার উপযোগী নেই।
কুয়ার গল্প এখানে শেষ হতে না হতেই শুরু অক্ষয় বটের গল্প। এ নামেই পরিচিত বেশি। গোঁসাইজি যখন বাংলা ১১০৩ অব্দে এখানে আসেন তখন এই বৃক্ষটি মাটি থেকে ভেদ হয়। কয়েকশ’ বছর ধরে গাছটি একই রকম রয়ে গেছে। সাধু সদানন্দ ও আশ্রমের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি সঞ্জয় কুমার কর্মকার জানাচ্ছিলেন সেরকমই।
অবশ্য আশপাশের মানুষজনের কথাও একইরকম। সবার কথা, আমরা জন্ম থেকেই গাছটারে এমনই দেখছি। কোনো পরিবর্তন নেই। বড় হয় না। নবান্ন, দোল পূর্ণিমা ও দশহরা- এই তিনটি বড় উৎসবের সময় কয়েক হাজার ভক্ত জড়ো হন এখানে। এই সময় বন্ধ্যা নারীরা বটতলায় ভিজা কাপড়ে বসে ধ্যান করাকালীন যদি কারও গায়ে বটের পাতা পড়ে তাহলে মেয়ে এবং ফল পড়লে ছেলে সন্তান হয়।
আশ্রমবাসীর তথ্যমতে, গত বছরেও ৫-৬ জন নারী এভাবে মা হয়েছেন।
কথা বলতে বলতে উঠান পেরিয়ে ফটক দিয়ে বেরিয়ে বাইরের একটি পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে জানা গেলো আরও একটি গল্প। এর খোঁজ জানা যায় আগেই। তাই নাটোর শহর থেকে প্রায় ৫৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আশ্রমে। প্রথমে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় ওয়ালিয়া। ওয়ালিয়া থেকে লালপুর বাজার নছিমনে। সেখান থেকে আরও ৮ কিলোমিটার দূরে রামকৃষ্ণপুর। রাস্তার অবস্থা বিশেষ ভালো না। তবে এক/দু’শ’ মানুষ একবারে গেলেও নিরামিষ ভোজ আর থাকার ব্যবস্থা আছে।
যাইহোক ‘অলৌকিক’ নারিকেল গাছের গল্প শুনে কষ্ট সহ্য করে হলেও যেতে চাইবেন।
একটি নারিকেল গাছ রাতারাতি পুকুরের কিনার থেকে মাঝে চলে যাওয়ায় আলোড়ন ফেলেছিলো ৫-৬ বছর আগে।
সাধু সদানন্দ ও সঞ্জয় জানাচ্ছিলেন, পুকুরের কিনারে একটি বড় নারিকেল গাছ ছিলো। গাছটিতে নারকেলও হতো প্রচুর। হঠাৎ একদিন সকালে দেখা যায়, গাছটি কিনার থেকে প্রায় ২০-২৫ হাত পুকুরের ভেতরের দিকে চলে গেছে। এ ঘটনায় তোলপাড় হয়ে যায় গোটা এলাকা। হাজার হাজার মানুষ আসেন দেখতে। কিন্তু গাছটি মাস না গড়াতেই মারা যায়। তখন কেটে সরিয়ে ফেলা হয়।
আশ্রমের দায়িত্বশীল ও ভক্ত বৈষ্ণবদের মতে তাদের গোঁসাইয়ের সাধনা ও
সাধারণ মানুষের কাছে এসব ঘটনা অলৌকিক। তবু বিশ্বাস তাদের পিছু ছাড়ে না। ভিন্নমত যে নেই তাও নয়।
এ বিষয়ে কথা হয় স্থানীয় বাসিন্দা আবু তালেবের সঙ্গে। পেশায় তিনি কৃষিজীবী। বয়স ষাটের বেশি। প্রথমে তার সঙ্গে কথা হয় নারিকেল গাছ বিষয়ে। বলেন, গাছটি পুকুরের পাড়েই ছিলো। একদিন সকালে হঠাৎই পুকুরের ভিতরে ঢুকে যায়। গাছটি যে পাড়েই ছিলো সেটা সবসময় দেখেছি।
তবে ভিন্নমত পোষণ করেন দুড়দুড়িয়ার ভেল্লাবাড়িয়া আব্দুল ওয়াহেদ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এনামুল হক। তিনি বলেন, গাছ পুকুরের ভিতরে চলে গিয়েছিলো এটা ঠিক, তবে এটি কোনো অলৌকিক ঘটনা বলে মনে করি না। কারণ এ পুকুরে মাছ চাষ হয়। মাছের খাবার দেওয়া হয় পাড়ঘেঁষে। মাছ খাবার খেতে খেতে এভাবে গাছের গোড়ার মাটি আলগা হয়ে গাছ সরে যেতে পারে। একই মত দেন সহকারী শিক্ষক আব্দুর রশীদও।
এছাড়া বটগাছ ও কুয়া সম্পর্কে ছোটকাল থেকে ওই এলাকায় বেড়ে ওঠা আবু তালেব সুর মেলান সাধু ও সঞ্জয়ের সঙ্গে। আর শিক্ষক এনামুল ও রশীদ জানান, এমন ঘটনা শোনা যায়, তবে কতটুকু সত্যি জানি না।
বাংলাদেশ সময়: ০৭২৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৮, ২০১৬
এএ/জেডএম