বগুড়া: আমিরুন বিবি। মুখ ও কপালের চামড়ায় অসংখ্য ভাঁজে স্পষ্ট বয়সের ছাপ।
তিন মেয়ে ও দুই ছেলে তার। সবাই বিবাহিত। অভাবের তাড়নায় যে যার মতো করে সংসার নিয়ে ব্যস্ত। আমিরুনকে নিয়ে তাদের কারো ভাবার সময় নেই। ভাগ্য তাকে একা করে দিয়েছে। ফলে এ বয়সেও দু’মুঠো অন্নের জন্য দ্বারে-দ্বারে ঘুরতে হয় এই হতভাগা বৃদ্ধাকে।
কিন্তু প্রকৃতিও যেন তার সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ করছে। শীতের তীব্রতা তার জন্য চরম দুর্ভোগ তৈরি করেছে। শীতের ছোবলে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন তিনি। কনকনে শীতের কারণে ঠিকমতো মানুষের দ্বারে-দ্বারে যেতে পারছেন না। ভাগ্যে অন্নও জুটছে না। ফলে অনেকটা খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে তার।
দিন শেষে এখন প্রায়রাতেই আমিরুনকে বগুড়া রেলওয়ে স্টেশনের প্লাটফর্মে পাওয়া যায়। সারাদিন চেয়ে-চিন্তে খেয়ে রাতযাপন করেন এখানে। সবকিছু থেকেও কিছু না থাকা আমিরুনের বাড়ি গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলায়।
তার মতো আরো অসংখ্য ছিন্নমূল নারী-পুরুষ, তরুণ-তরুণী ও শিশু-কিশোর রাতযাপন করেন এ স্টেশনে। অন্যান্য সময় তাদের তেমন সমস্যা না হলেও শীতের তীব্রতা এসব ছিন্নমূলদের ভোগাচ্ছে খুব।
রোববার (২৪ জানুয়ারি) রাত ৮টার দিকে বগুড়া রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় গিয়ে দেখা মিললো আমিরুনসহ অনেক ছিন্নমূল মানুষের।
স্টেশনে অনেক নারী-পুরুষ জটলা হয়ে বসে আছেন। শীতের তীব্রতা থেকে বাঁচতে কেউ কেউ একমাত্র সম্বল শীতের পোশাক গায়ে জড়িয়ে আছেন। কেউ সামান্য কাপড় বিছিয়ে শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছেন। কেউবা অন্যের দেওয়া খাবার নিজে ও বাচ্চাকে খাওয়াচ্ছেন। কোথাও কোথাও নারী-পুরুষ ও শিশুরা শীত থেকে নিজেকে রক্ষায় আগুন পোহাচ্ছেন।
তবে রাত ঘনিয়ে আসার সঙ্গে শীতের পাগলামিও বেড়ে যাওয়ায় বেশ বিপাকে রয়েছেন এসব ভাসমান মানুষ। শীতের রাত যেন তাদের শেষ হতে চায় না। তীব্র হাঁড় কাঁপানো শীত তাদের বিপর্যস্ত করে তুললেও তাদের এ কষ্ট দাগ কাঁটতে পারেনি বিত্তবানদের মনে।
কথা হয় মোমেনা ও হালিমার সঙ্গে। তারা জানান, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে তাদের গ্রামের বাড়ি। কিন্তু সেখানে মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। অভাব তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। পেটের দায়ে তারা বগুড়া শহরের এসেছেন। শরীরে শক্তি সামর্থ্য না থাকায় তারা কাজও করতে পারেন না। তাই গত কয়েকমাস ধরে এই প্লাটফর্মে এসে ঠাঁই নিয়েছেন। দিনে তারা খাবারের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েন। সারাদিন শহরের বিভিন্ন বাসাবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে বেড়ান। এভাবে দিন শেষে কপালে যা মেলে তাতেই চলে তাদের জীবন।
তবে এবার শীত তাদের কাবু করে ফেলেছে। কারণ কয়েকদিন ধরে ভোর থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত সূর্য্যের দেখা মিলছে না। শীতের তীব্রতাও বাড়ছে। শীত নিবারণের কোনো পোষাকও তাদের নেই। তীব্র ঠাণ্ডায় তারা বেশি সময় ঘোরাঘুরিও করতে পারছেন না। ফলে ঠিকমত খাবারও জুটছে না। এতে করে অনেক সময় তাদের না খেয়ে থাকতে হচ্ছে।
বৃদ্ধ মোবারক হোসেন ও আজাহার আলী বলেন, সামর্থ্যবানরা ইচ্ছে হলেই ঘরে থাকতে পারেন। কিন্তু গরিবরা তা পারে না। শত যাতনা নিয়েও তাদের দু’মুঠো অন্নের জন্য মানুষের দ্বারে-দ্বারে ছুটতে হয়।
কিশোর সবুজ, শাকিল, রঞ্জু জানায়, তারাও মা-বাবার সঙ্গে এখানে থাকে। দিনে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ থেকে কাগজ কুড়ানো তাদের পেশা। কিন্তু এবার শীত তাদের কাবু করে ফেলেছে। শীতের কারণে ঠিকমতো কাগজ কুড়াতে পারছে না। ফলে চরম কষ্টে দিনাতিপাত করছে হচ্ছে তাদের।
বাংলাদেশ সময়: ০৫৫৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৫, ২০১৬
এমবিএইচ/এসআর