ঢাকা: একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেফতারকৃত ময়মনসিংহ-৭ (ত্রিশাল) আসনের সংসদ সদস্য এম এ হান্নানসহ আটজনের বিরুদ্ধে আগামী ২৩ মার্চ তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের দিন ধার্য করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
এম এ হান্নানসহ এ মামলার পাঁচ আসামি গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন।
মামলার মোট আট আসামির বিরুদ্ধে সোমবার (২৫ জানুয়ারি) তদন্তের অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করেন প্রসিকিউটর রেজিয়া সুলতানা চমন। তিনি তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিতে চারমাসের সময়ের আবেদন জানালে আগামী ২৩ মার্চ দিন ধার্য করেন চেয়ারম্যান বিচারপতি মোহাম্মাদ আনোয়ার উল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল।
এদিকে এম এ হান্নান ও তার ছেলে রফিক সাজ্জাদের জোমিন চেয়ে আবেদন জানিয়ে শুনানি করেন তাদের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম। জামিনের বিপক্ষে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সীমন ও রেজিয়া সুলতানা চমন। এ আবেদনের বিষয়ে আগামী ৪ ফেব্রুয়ারি আদেশের দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল।
গত বছরের ১ অক্টোবর প্রসিকিউশনের আবেদনক্রমে এ মামলার আট আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। পরে ওইদিনই ঢাকায় গ্রেফতার হন এম এ হান্নান ও তার ছেলে রফিক সাজ্জাদ। ময়মনসিংহ সদর ও ত্রিশালে গ্রেফতার হন বাকি তিনজন।
গত বছরের ১৯ মে এমপি হান্নানসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মামলাটি দায়ের করেন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুর রহমানের স্ত্রী রহিমা খাতুন।
মামলায় জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য এম এ হান্নান ছাড়াও জামায়াত নেতা ফকরুজ্জামান ও শহরতলীর গলগণ্ডা এলাকার গোলাম রব্বানীকে আসামি করা হয়। পরে তদন্তে আরও পাঁচজনের সম্পৃক্ততা পাওয়ায় এ মামলার আসামি হয়েছেন মোট আটজন।
বাদিনী ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার বৈলর মুন্সীপাড়া এলাকার শহীদজায়া রহিমা খাতুন মামলায় অভিযোগ করেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সক্রিয় সহায়তার লক্ষ্যে এম এ হান্নান ময়মনসিংহ জেলা শান্তি কমিটি গঠন করে এর সাধারণ সম্পাদক হন। ফকরুজ্জামান ও গোলাম রব্বানি আলবদর বাহিনীর সশস্ত্র সদস্য হিসেবে হান্নানের সহযোগী ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আসামিরা শহরের নতুন বাজারে অবস্থিত এম এ হান্নানের নিজ বাসভবন, জেলা পরিষদ ডাকবাংলো টর্চার সেলের দায়িত্বে থেকে মুক্তিকামী সাধারণ নিরীহ মানুষদের ধরে এনে হত্যা করে মরদেহ ব্রহ্মপুত্র নদের চরে ফেলে রাখেন।
মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুর রহমানকে আসামি আব্দুল হান্নান তাদের সহযোগী রাজাকারদের সহযোগিতায় গৌরীপুর থানার ভাঙনামারী চর থেকে ১৯৭১ সালের ৯ অক্টোবর বিকেল চারটার সময় ধরে আনেন। পরে ময়মনসিংহ শহরের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় টর্চার সেলে প্রকাশ্য দিবালোকে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুর রহমানের দুই চোখ উপড়ে ফেলে ও ডান হাত ভেঙে দিয়ে নিজে গুলি করে হত্যা করেন এম এ হান্নান। আসামিরা সহযোগী রাজাকারদের নিয়ে আব্দুর রহমানের বাড়ি লুটপাট, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন।
মামলায় আরও অভিযোগ করা হয়, আসামিরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মনোরঞ্জনের জন্য ময়মনসিংহ শহরের যৌনপল্লী থেকে নারীদেরকে ধরে এনে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপিত পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে সরবরাহ করেন। পরে এসব নারীদের ধর্ষণের পর হত্যা করে মরদেহ ব্রহ্মপুত্র নদে ফেলে দেওয়া হয়।
এসব আসামিরা ময়মনসিংহ কোতোয়ালি থানার খাগডহর ইউনিয়নে মাইজপবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা আতাউর রহমান আতাকে ধরে নতুন বাজারে এম এ হান্নানের নিজ বাসায় বেয়নেট চার্জসহ অমানুষিক নির্যাতন শেষে হত্যা করে মরদেহ ব্রহ্মপুত্র নদে ফেলে দেন।
ময়মনসিংহ শহরের কাঁচিঝুলি এলাকার শামসুদ্দিন আহমেদ টেপা মিয়ার পুত্র ধারা, কলেজ রোড এলাকার আব্দুল খালেকের পুত্র রমজান, ডালপট্টি এলাকার আব্দুর রশিদ, চরপাড়ার নিজাম, মুমিনুন্নিসা কলেজের পেছনের সুরুজ আলী, মাইজবাড়ির আতা, আকুয়া হাজিবাড়ীর সুরুজ এবং ধোপাখোলা মোড়ের অ্যাথলেট শাহেদ আলীকে আলবদর বাহিনীকে দিয়ে ধরে এনে আসামিরা জেলা পরিষদের ডাকবাংলোর টর্চার সেলে বেয়নেট চার্জ ও গুলি করে হত্যা করে মরদেহ ব্রক্ষপুত্র নদে ফেলে দেন আসামিরা।
মামলায় আরও অভিযোগ করা হয়, মামলার সাক্ষী খন্দকার আব্দুল গণির সহোদর ছোট ভাই খন্দকার আব্দুল আলী রতনকে ১৯৭১ সালের অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে আসামি এম এ হান্নান তার সহযোগীদের নিয়ে গাঙ্গিনারপাড় মকবুল রেডিও সার্ভিসের সামনে থেকে ধরে তার নতুন বাজারের বাসায় নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে হাত-পা ভেঙে ফেলেন। পরে সন্ধ্যায় তাকে জেলা পরিষদের ডাকবাংলোর নিচে নিয়ে গুলি করে হত্যা করেন।
আব্দুল আলী রতনের মা ও বোন ফাতেমা জহুরা রতনকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য অনুনয়-বিনয় করলে আসামি হান্নান তাদেরকে হুমকি প্রদান করে বলেন, ‘তোমার বড় ছেলে আব্দুল গণিকে হত্যার জন্য গুলি লোড করা আছে’। এ কথা বলে তাদেরকে বের করে দেন।
আসামিরা নিজেরা ও তাদের রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর সদস্যদের দিয়ে ময়মনসিংহ অঞ্চলে গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, লুন্ঠন, অগ্নিসংযোগসহ ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালান বলেও মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৪৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৫, ২০১৬
এমএইচপি/ এএসআর