বগুড়া: বাড়ি থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে পারিবারিক কবরস্থান। সেই কবরে একমাত্র ছেলে, স্ত্রী ও শিশু কন্যাকে দাফন করা হচ্ছিল।
অপরদিকে বাড়ির আঙিনার শেষ সীমানায় বসেছিলেন চার বোন সাবিনা ইয়াসমিন, ফয়জুন্নাহার, ফকরুন্নাহার ও নাহিদা ইয়াসমিন। মাঝখানে সামান্য আবাদি জমি। এরপরেই কবরস্থান। সেখান থেকে সরাসরি সেই কবরস্থান দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু কারো মুখে কোনো কথা ছিল না।
সবাই শোকে বাকরুদ্ধ। প্রত্যেকের চোখের জল যেন শুকিয়ে গেছে।
বুধবার (২৭ জানুয়ারি) বেলা ১১টার দিকে বগুড়া সদর উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের খামারকান্দি গ্রামের শামসুদ্দিনের বাড়ির দৃশ্য ছিল এটি।
এই গ্রামের সন্তান ছিলেন ডা. মোঃ ফজলুল বারী মিঠু। স্ত্রী আসমা-উল-হুসনা (৩৪), শিশু কন্যা স্নেহা (১১), ফাইজা (৮), ছেলে পূর্ণ (৪) ও গৃহকর্মী সীমাকে (২১) সঙ্গে নিয়ে নিজ কারযোগে সোমবার (২৫ জানুয়ারি) দিনগত রাতে কুমিল্লার এক আত্মীয়ের বাসায় দাওয়াত শেষে ঢাকায় ফিরছিলেন।
পথিমধ্যে কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার টামটা এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় ডা. মোঃ ফজলুল বারী মিঠু, স্ত্রী আসমা-উল-হুসনা, শিশু কন্যা স্নেহা ও গৃহকর্মী সীমা নিহত হন। আর মেয়ে ফাইজা ও ছেলে পূর্ণ গুরুতর আহত হয়। দু’জনের মধ্যে পূর্ণ ঢাকায় চিকিৎসাধীন রয়েছে। ফাইজা আহত অবস্থায় শহরের নারুলীর বাসায় রয়েছে।
ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, ট্রাকযোগে তিনজনের মরদেহ গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। মরদেহ আসার আগ থেকেই খামারকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠসহ আশেপাশের এলাকায় বিপুল সংখ্যক মানুষ জড়ো হন। বিশেষ করে নারীদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো।
ট্রাক থেকে মরদেহ নামানোর পর দলে দলে মানুষ কফিনের দিকে এগিয়ে আসতে থাকেন। সবাই নিহতদের মরদেহ একনজর দেখার ইচ্ছে পোষণ করেন। নিহতদের স্বজনরা সাধ্যানুসারে মানুষকে মরদেহ দেখানোর চেষ্টা করেন।
এর মধ্যে সেখানে ওয়ারেজসহ কয়েকজনের সহযোগিতায় হুইল চেয়ারে বসে ছেলে, পুত্রবধূ ও নাতনির মরদেহ দেখতে আসেন বৃদ্ধ বাবা শামসুদ্দিন। ভিড় ঠেলে সবাই তাকে সন্তান, পুত্রবধূ ও নাতনির কাছে নিয়ে যান। তখন সেখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অতারণা হয়। যা দেখে উপস্থিত সবার চোখও জলে ভরে যায়।
পরে শামসুদ্দিনকে সেখান থেকে বাড়ির প্রধান ফটকের সামনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে সেই চেয়ারে বসিয়ে রাখা হয়। আর তার চারপাশ ঘিরে রাখেন পরিবারের লোকজন, স্বজন, প্রতিবেশী ও গুণগ্রাহীরা।
এ সময় অনেককে তাকে শান্ত্বনা দিতে দেখা যায়। কিন্তু তাতে তার কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। শুধুই সবার দিকে ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে দেখা যায়। বোনদের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। তারা কারো সঙ্গে কোন কথা বলছিলেন না। শুধুই কবরের দিকে তাকাচ্ছিলেন।
নিহত ডা. মিঠুর চাচাতো ভাই দেলোয়ার হোসেন মুক্তার বাংলানিউজকে জানান, একমাত্র ছেলের মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকেই বাবা শামসুদ্দিন পাগলপ্রায়। একটি পরিবার থেকে তিনটি প্রাণ একসঙ্গে ঝরে যাওয়ার পর কেউ স্বাভাবিক থাকতে পারে না। এরপর তিনি অনেকদিন হলো অসুস্থ।
বোনদের অবস্থাও অনুরূপ। তারাও একমাত্র ভাই, ভাবী ও ভাতিজির মৃত্যুর বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারছেন না। তাদের মৃত্যুতে পরিবারটি একদম ভেঙে পড়েছে। এ কারণে তারা কারো সঙ্গে ঠিকমতো কথা বলতে পারছেন না বলে জানান মুক্তার।
বাংলাদেশ সময়: ১৬২৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৭, ২০১৬
এমবিএইচ/এএসআর