ঢাকা: স্পিকারের অনুমতি সাপেক্ষে জাতীয় সংসদ ভবনসহ আগারগাঁও এলাকার স্থাপত্যের মূল নকশা যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনতে চায় গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের স্থাপত্য অধিদপ্তর।
সোমবার (১ ফেব্রুয়ারি) এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের অনুমতি চেয়ে আবেদন করবে বলে জানা গেছে।
এক রিট মামলায় গত ৪ নভেম্বর স্থপতি লুই আই কানের তৈরি জাতীয় সংসদ কমপ্লেক্সের মূল নকশা তিনমাসের মধ্যে দাখিলের নির্দেশ দিয়েছিলো সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। তবে এ সময়ের মধ্যে আদালতে তা উপস্থাপনের সম্ভাবনা নেই। কারণ প্রকৌশলীদের যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানোর পর আরও একমাস সময় লাগতে পারে।
এদিকে পূর্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বৃহস্পতিবার সংসদে এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় বিখ্যাত স্থপতি লুই আই কান প্রণীত জাতীয় সংসদ ভবন কমপ্লেক্স, তদসংলগ্ন এলাকার মহাপরিকল্পনাসহ অন্যান্য সকল অঙ্গের স্থাপত্য নকশা সংগ্রহের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়া ইউনিভার্সিটি আর্কিটেকচারাল আর্কাইভ এর সাথে ই-মেইলের মাধ্যমে যোগাযোগ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ১৫ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র হতে ড্রইং ইনভেন্টরি লিস্ট (Drawing inventory list) এর চূড়ান্ত তালিকা পাঠানো হয়েছে। এই তালিকা হতে প্রয়োজনীয় নকশা চিহ্নত করে তা সংগ্রহের ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
এ নকশা আনার বিষয়ে জানতে চাইলে রোববার দুপুরে স্থাপত্য অধিদপ্তরের প্রধান স্থপতি কাজী গোলাম নাসির বাংলানিউজকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়া ইউনির্ভাসিটির স্থাপত্য বিভাগ আমাদের শেরে বাংলা নগরের সকল নকশার তালিকা দিয়েছে। এতে দেখা গেছে, ৮ হাজারের উপরে নকশা রয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা জাতীয় সংসদের স্পিকারকে আপডেট তথ্য জানিয়েছি। স্পিকার এবং সংসদ সচিবালয় আমাদের মৌখিকভাবে বলেছে নকশা আনার জন্য, যদিও এই নকশা আনার দায়িত্ব সংসদ সচিবালয়ের। তারা যেহেতু আমাদেরকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলেছে, তাই আমরা পূর্ত মন্ত্রণালয়কে সোমবার (০১ ফেব্রুয়ারি) চিঠি দেবো যে, সংসদ সচিবালয় নকশা আনার পদক্ষেপ নিতে বলেছে। এখন মন্ত্রণালয় যদি আমাদের দায়িত্ব দেয় তাহলে নকশা বাছাই করে আনতে হলে ৪/৫ জন স্থপতিকে (যারা নকশা বুঝেন) সেখানে যেতে হবে। তারপর ৮ হাজার নকশা থেকে বাছাই করে যেটা প্রয়োজন সেটা পেমেন্ট করে আনতে হবে। এতে নকশা প্রতি খরচ হবে ৫০ ইউএস ডলার, এর সঙ্গে যারা যাবেন তাদের আসা যাওয়ার এবং থাকার খরচ যোগ করতে হবে। বাছাই করে আনতে হলে তাতে এক মাস সময় লাগবে বলে জানান এই স্থপতি।
যদি সব নকশাই আনতে বলে তাহলে যে কেউ একজন গেলেই টাকা দিয়ে নিয়ে আসা যাবে। তাতেও সময়ের প্রয়োজন বলে মন্তব্য স্থপতি কাজী গোলাম নাসিরের।
সংসদ ভবনের নকশা সংগ্রহের বিষয়টি অনুধাবন করে সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি লুই আই কান এর মূল নকশা সংগ্রহের নির্দেশ দেন সংসদ সচিবালয়কে। সর্বশেষ ২০১৫ সালের ১৩ অক্টোবর একনেক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী লুই আই কান এর মূল নকশা আনার নির্দেশনা দেন। কেননা মূল নকশা হাতে না থাকায় সচিবালয় সেগুণবাগিচা হতে আগারগাঁও এ স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করতে পারছে না।
সংসদ সচিবালয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৭৪ সালে লুই আই কান যখন মূল নকশাটি করেন, তখন ২৭টি মন্ত্রণালয়ের জন্য এ পরিকল্পনা করেন। তখন সেখানে মসজিদ ছিল, মাঝে বাগান ছিল, চন্দ্রিমা উদ্যানের ওখানে একটি বড় সড়ক ছিল, এর সামনে লেক ছিল, এরপর সংসদ ভবন ছিল। তাই অনুলিপি ধরে নয়, ১৯৭৪ সালের মূল নকশা ধরে সচিবালয়সহ সব কিছু করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
১৯৭৪ সালে শেরেবাংলা নগরে ৪২ একর জায়গায় জাতীয় সচিবালয় নির্মাণের জন্য সরকার ও মার্কিন কোম্পানি ডেভিড উইসডম অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের সঙ্গে চুক্তি হয়। পরে এর কোনো অগ্রগতি হয়নি। ওই এলাকায় এরই মধ্যে ১০ একর জমিতে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। জমি কমে যাওয়া এবং বর্তমানের চাহিদা বিবেচনায় লুই আই কানের নকশা স্থাপত্য অধিদপ্তর কিছুটা সংশোধন করেছে।
নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে জিয়াউর রহমান ও এইচএম এরশাদ সংসদ ভবন এলাকার ভেতরেই গড়ে তোলেন মাজার ও কবরস্থান। এর মধ্যে সংসদ ভবনের উত্তরে ৭৪ একর জায়গা জুড়ে নির্মিত চন্দ্রিমা উদ্যানের মধ্যিখানে বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে তোলা হয় জিয়ার মাজার কমপ্লেক্স। আর জিয়া ও এরশাদের শাসনামল মিলিয়ে সংসদ ভবনের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে মানিক মিয়া এভিনিউ এর পশ্চিম প্রান্ত লাগোয়া স্থানে পাঁচ বিঘারও বেশি জায়গাজুড়ে ‘জাতীয় কবরস্থান’ নাম দিয়ে আরো অন্তত সাতজনকে সমাধিস্থ করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, লুই আই কানের মূল নকশার প্রথম ধাপ ছিল ২০৮ একর জায়গার ওপর জাতীয় সংসদ ভবন নির্মাণ। যার সামনে ও পেছনেও বিস্তীর্ণ সবুজ খোলা মাঠ থাকবে। চারদিকে আট লেনের সড়ক, মাঝখানেও লেক। দ্বিতীয় ধাপে লেকের পর বিস্তীর্ণ সবুজ। এছাড়া বাকি জায়গায় গড়ে তোলা হবে সচিবালয়, লাইব্রেরি, জাদুঘর, হাসপাতালসহ প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক বলয়।
লুই আই কানের নকশা ক্ষত-বিক্ষত করার প্রক্রিয়া এখানেই থেমে থাকেনি। ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার। ওই সরকারের গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী হন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। লুই আই কানের নকশা উপেক্ষা করে আসাদগেটের উল্টো দিকে অবস্থিত সংসদ ভবনের জায়গায় একটি পেট্রোলপাম্প স্থাপনের জন্য তিনি তার ছোট ভাই মির্জা খোকনকে জায়গা বরাদ্দ দেন।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মাঝামাঝি সময়ে আরও এক দফা ক্ষত-বিক্ষত করা হয় লুই আই কানের মূল নকশা। ওই সময় সংসদ ভবনের মূল ভবনের পাশেই খোলা সবুজ চত্বরে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের বাসভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। বিষয়টি শেষপর্যন্ত আদালত পর্যন্ত গড়ায়। ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্ট (আইএবি) এবং বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) যৌথভাবে সংসদ সচিবালয় ও গণপূর্তের এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করে। রায় আইএবি এবং বাপার পক্ষে গেলেও নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়নি। আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা করেই নির্মাণ করা হয় স্পিকার এবং ডেপুটি স্পিকারের বাসভবন।
এদিকে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। এ মামলার শুনানিতে গত ৪ নভেম্বর স্থপতি লুই আই কানের তৈরি জাতীয় সংসদ কমপ্লেক্সের মূল নকশা তিনমাসের মধ্যে দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
জাতীয় সংসদের ইতিকথা
১৯৬১ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের আমলে বর্তমান সংসদ ভবন নির্মাণ কাজ শুরু হয়। সে সময় স্থপতি মাজহারুল ইসলামকে এই ভবনের স্থপতি নিয়োগ করা হয়। তার প্রস্তাবেই লুই আই কান এই প্রকল্পের প্রধান স্থপতি হিসেবে নিয়োগ পান। দীর্ঘ সাধনার পর ১৯৮২ সালের ২৮ জানুয়ারি এ ভবনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৫৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০১, ২০১৬
ইএস/এসএম/জেডএম