হাতিয়া থেকে ফিরে: চমৎকার উচ্চারণে বাংলা-ইংরেজির মিশ্রণে গ্রহণযোগ্য বিশ্লেষণ, শরীরী ভাষার ব্যবহার, পরিপাটি পোশাক- সব কিছু মুগ্ধ হওয়ার মত। মনে হলো, যা নিয়ে কথা বলছেন সে বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা রাখেন, বুঝিয়ে বলার ক্ষমতাও চমৎকার।
দেশের মূল ভূ-খণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন অনগ্রসর জনপদ হাতিয়া উপজেলার চেয়ারম্যান মো. মাহবুব মোর্শেদকে নিয়ে লিখতে গেলে এ কথাগুলোই বলতে হবে।
উপকূলীয় জনপদের মানুষ তাকে ঠিক চিনে নিয়েছে। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে, কারণে-অকারণে তার কাছেই যত আবেদন-নিবেদন। মাহবুব মোর্শেদকে দ্বীপ হাতিয়ার বাতিঘর বলা চলে।
সম্প্রতি নিঝুম দ্বীপ সফরে গিয়ে দেখা হয়ে যায় ৫২ বছর বয়সী এই তারুণ্যভরা মানুষটির সঙ্গে।
নিজের মতো দপ্তরটিও পরিপাটি। সেখানে বসে দ্বীপ হাতিয়া নিয়ে নিজের স্বপ্ন, অভিজ্ঞতা, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, সমস্যা, সমস্যা সমাধের উপায় এবং নিজের কিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরছিলেন সফরকারী এক সাংবাদিক দলের সামনে।
দীর্ঘ অভিজ্ঞতার ঝুলিতে রয়েছে ৫৯টি দেশ সফর থেকে পাওয়া জ্ঞান। পৃথিবীর বিখ্যাত পর্যটন স্পটগুলো ঘুরে দেখেছেন তিনি। আর সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে নিঝুম দ্বীপকে বাংলাদেশ তো বটেই, পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ পর্যটন স্পট হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন মাহবুব মোর্শেদ।
তাই প্রধানমন্ত্রী ২০১৬ সালকে পর্যটন বছর ঘোষণার পর এক সেকেন্ড দেরি করেননি মাহবুব মোর্শেদ। সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছেন নিঝুম দ্বীপসহ হাতিয়ার আরো দুইটি স্পট কাজির বাজার ও সূর্যমুখী স্পটকে পর্যটন স্পট হিসেবে ঘোষণা করে সেখানে অবকাঠামগত উন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য।
নিঝুম দ্বীপ সৌন্দর্যের অন্যতম অনুষঙ্গ ক্রমশ কমতে থাকা হরিণ রক্ষায় কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছেন তিনি। স্থানীয় প্রাশসন, বনরক্ষী, বন কর্মকর্তা, প্রাভাবশালী ও অসাধু ব্যক্তি এমনকি নিজ দলের সুযোগ সন্ধানী কর্মী- সমর্থকদের ব্যাপারে জিরো টরারেন্স দেখানোয় বেঘরে আর প্রাণ যাচ্ছে না নিঝুম দ্বীপের মায়াবী হরিণদের।
উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত মাহবুব মোর্শেদ উপলব্ধিতে রয়েছে, অনগ্রসর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়াকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে না পারলে দিন বদলের স্বপ্ন কোনো দিন পূরণ হবে না। এ জন্য শিক্ষা বিস্তারে নিয়েছেন অভূতপূর্ব সব উদ্যোগ।
একটি গল্প শোনালেন। সেবার বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) অধ্যয়নরত হাতিয়ার এক মেধাবী ছাত্র তাকে জানিয়েছিলেন, দুই বন্ধুকে নিয়ে সেন্টমার্টিন ঘুরতে যাচ্ছেন। কিন্তু মাহবুব মোর্শেদ তাদের আমন্ত্রণ জানালেন নিঝুম দ্বীপে ঘুরে যেতে, তারই অতিথি হয়ে।
গাঁটের পয়সা খরচ করে বুয়েটের তিন শিক্ষার্থীকে নিঝুম দ্বীপে কেন ডাকলেন সে কারণটিও চমৎকার।
‘আমার মাথায় ছিলো ভিন্ন চিন্তা,’ বলেন মাহবুব মোর্শেদ।
ওদের সফর নিশ্চিত হলো। হাতিয়া এলো। আর আমি হাতিয়ায় বিভিন্ন স্কুলে এবার এসএসসি পরীক্ষার্থীদের মধ্যে জিপিএ-৫ প্রত্যাশী ২৪০ জন শিক্ষার্থীকে উপজেলা কমপ্লেক্সের হলরুমে ডাকলাম। সেখানে টানা ৩ দিন ৩ ঘণ্টা করে মোট ৯ ঘণ্টা ক্লাস নিলো ওই মেধাবী তিন তরুণ। উদ্যোগটি হাতিয়ার কোমলমতী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে দেয়। অভিভাবকরাও খুশি হন। আর দূর এই দ্বীপে এসে এমন একটি কাজে অংশ নিতে পেরে বুয়েটের তিন শিক্ষার্থীও ভীষণ খুশি।
সকলের খুশির মধ্য দিয়েই অর্জিত হলো বড় কিছু।
একজন শিক্ষানুরাগী, জনহিতৈষী জনপ্রতিনিধির পক্ষেই এমন একটি উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব, বললেন উপস্থিত অনেকেই।
এ বছর জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর অন্য রকম এক উদ্যোগ নেন মাহবুব মোর্শেদ। ভাল রেজাল্ট করা স্কুলগুলোকে গ্রিন মার্ক এবং অপেক্ষাকৃত খারাপ রেজাল্ট করা স্কুলগুলোকে ইয়োলো মার্ক করেন।
ফল প্রকাশের পরের দিনই গ্রিন মার্কড স্কুলগুলোর প্রধান শিক্ষকসহ সব শিক্ষককে ডেকে মিষ্টিমুখ করান। আর ইয়েলো মার্কড স্কুলের প্রধান শিক্ষককে দ্রুত কারণ দর্শাতে বলেন।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে- এর আগে হাতিয়ার কোনো জনপ্রতিনিধি শিক্ষা বিস্তার ও শিক্ষার উন্নয়নে এত বেশি সময়-শ্রম ও ব্যক্তিগত অর্থ ব্যয় করেননি।
শিক্ষার মত স্বাস্থ্য সেবায়ও মাঠে নেমে কাজ করছেন মাহবুব মোর্শেদ। হাতিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটির ছিল জরাজীর্ণ অবস্থায়। এখানে চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ান, মেশিনারিজ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কর্মী-সব কিছুই ছিল না থাকার মত। ২০১৪ সালে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেন মাহবুব মোর্শেদ। ব্যক্তিগত উদ্যোগে এখানে নিয়োগ দেন ১ জন নার্স, ১ জন পরিচ্ছন্নতা কর্মী। ফিরিয়ে আনেন হাসপাতালে সেবার পরিবেশ। এখন সেখানে নিয়মিত সিজার, নরমাল ডেলিভারিসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারছেন হাতিয়ার নারীরা।
তবে এ ব্যাপারে মাহবুব মোর্শেদের মূল্যায়ন হল- হাতিয়ার ৯৯ ভাগ মানুষ সুস্থ। বিশুদ্ধ অক্সিজেন, তাজা খাবার আর কঠোর পরিশ্রম দ্বীপ হাতিয়ার মানুষকে রোগমুক্ত রেখেছে। এ কারণে তাদেরকে খুব একটা বেশি চিকিৎসকের কাছে ছোটাছুটি করতে হয় না। কেবল প্রসূতি মায়ের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার প্রয়োজন ছিল। সেটা মোটামুটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মাধ্যমে নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে।
মানব সভ্যতার অগ্রগতিতে দ্রুত তরান্বিত করতে বিদ্যুতের ভূমিকা মাথায় রেখে দ্বীপ হাতিয়ায় বিদ্যুতের উৎপাদন ও ব্যবহারের সুযোগ বাড়াতে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন মাহবুব মোর্শেদ। ডিজেল চালিত জেনারেটর ও হাইব্রিড স্যোলার প্যানেলের মাধ্যমে মোট পাঁচ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হত হাতিয়ায়।
সম্প্রতি মাহবুব মোর্শেদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আরো ১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হয়েছে হাতিয়ায়।
পরের খবরটা আরো চমকপ্রদ। সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে হাতিয়াকে ন্যাশনাল গ্রিডে অ্যাড করার জন্য তার নানামুখী তৎপরতায় সম্প্রতি বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় থেকে উচ্চ পর্যায়ে একটি বিশেষজ্ঞ দল হাতিয়ায় যায় সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য।
মাহবুব মোর্শেদের প্রত্যাশা, খুব শিগগিরই সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে তার দ্বীপ হাতিয়া ন্যাশনাল গ্রিডের সঙ্গে যুক্ত হবে।
১৯৭০ সাল। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের এক বছর আগে হাতিয়ার নদী ভাঙ্গন ভয়াবহ আকার ধারণ করে। এরই প্রেক্ষিতে স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে স্থানীয় সংসদ সদস্য প্রয়াত আমিরুল ইসলাম কালামের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় নেদারল্যান্ডের একটি বিশেষজ্ঞ দল নদী রক্ষা, নদী শাসন ও নদী নিয়ন্ত্রণের সম্ভব্যতা যাচাইয়ের জন্য হাতিয়া যায়।
নানা রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে তারা রিপোর্ট দেয়- হাতিয়া আনপ্রেডিক্টেবল একটা এরিয়া। এখানকার নদীর যে প্রকৃতি, নদীর যে স্রোত এবং মাটির যে নেচার- তাতে নদী শাসন খুব একটা ফলপ্রসূ হবে না। করতে গেলে এমন একটা বাজেট দরকার, যা বাংলাদেশ সরকার দিতে পারবে না।
২০০১ সালে মাহবুব মোর্শেদের বড় ভাই মোহম্মদ আলী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর ফের বিষয়টি নিয়ে নাড়াচাড়া দেন। অত:পর নেদারল্যান্ডের আরেকটি বিশেষজ্ঞ টিম হাতিয়া যায়। সম্ভাব্যতা যাচাই শেষে তারাও নেগেটিভ রিপোর্ট দেয়।
কিন্তু হাল ছাড়ার বান্দা নন সারা দুনিয়া চষে বেড়ানো ডাইনামিক ক্যারেক্টার মাহবুব মোর্শেদ। ২০১৪ সালে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে আবার নাড়াচাড়া শুরু করেন তিনি। বার বার ধর্ণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে। অবশেষে প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে লিখে দেন-যথাযথা ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য।
এর পর পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি বিশেষজ্ঞ দল বেশ কয়েকবার হাতিয়া ভিজিট করেছেন। সম্ভব্যতা যাচাই করে মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট পেশ করেছেন। মাহবুব মোর্শেদের প্রত্যাশা- এবার পজেটিভ রেজাল্ট আসবে। কারণ, প্রযুক্তির প্রভূত উন্নয়ন সাধন হয়েছে। দেশও অনেক দূর এগিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীকে যখন দরখাস্তটা দিই, তখন তিনি বলেন, তোমরা এত নদী ভাঙন ভাঙন করে কেন? ভাঙে ১ কিলোমিটার, গড়ে ১০০ কিলোমিটার। এত অস্থির হও কেন? তার পরও আমি হাল ছাড়িনি। নদী ভাঙন ঠেকানো না গেলে এখানে কোনো উন্নয়ন-ই টেকসই হবে না।
এত কাজের উৎসাহ – অনুপ্রেরণা কোথায় পান? মাহবুব মোর্শেদের সরল উত্তর- মানুষের ভালবাসা থেকে।
তবে সাবেক সংসদ সদস্য বড় ভাই মোহম্মদ আলী এবং বর্তমান সংসদ সদস্য আয়েশা ফেরদাউস‘র লজিস্টিক সাপোর্টের কথাও অকপটে স্বীকার করলেন দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার বাতিঘর মো. মাহবুব মোর্শেদ।
বাংলাদেশ সময়: ০৮১৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০১, ২০১৬
এজেড/জেডএম