ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

কুড়িগ্রাম থেকে পিয়াস ও স্বপন

আ. লীগের জোরালো প্রস্তুতি পিছিয়ে বিএনপি

মেহেদী হাসান পিয়াস ও ফজলে ইলাহী স্বপন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪২৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২, ২০১৬
আ. লীগের জোরালো প্রস্তুতি পিছিয়ে বিএনপি

কুড়িগ্রাম থেকে: পৌরসভা নির্বাচনের পর দেশে স্থানীয় সরকারের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচনও রাজনৈতিক দলের পরিচয় ও প্রতীকে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে সে অনুযায়ীই প্রস্তুতি নিচ্ছে দেশের রাজনৈতিক দল ও দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা।

তবে মাঠের প্রস্তুতির চেয়ে সম্ভাব্য প্রার্থীরা দলের মনোনয়ন নিশ্চিত করতেই এখন বেশি ব্যস্ত।
 
উত্তর বঙ্গের জেলা কুড়িগ্রামে গিয়ে এমনটাই চোখে পড়লো। ভোটারদের মন জয় করার চেয়ে সম্ভাব্য প্রার্থীরা দল এবং দলের প্রভাবশালী নেতাদের মন জয় করতেই উঠেপড়ে লেগেছেন। তবে দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচনের বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন বিভিন্ন দলের জেলা নেতৃত্ব, প্রার্থী এবং খোদ ভোটাররাও।    
 
ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের কুড়িগ্রাম জেলার নেতৃত্বের মধ্যেও এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। তাদের কেউ কেউ মনে করছেন, দলের স্বার্থেই দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত থেকে সরকারের সরে আসা উচিৎ।
 
পৌর নির্বাচনের অভিজ্ঞতা টেনে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কুড়িগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা বাংলানিউজকে বলেন, নানা বিষয়ে জেলা নেতৃত্বের মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে। এতদিন এসব দ্বন্দ্ব জেলা নেতৃত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও পৌর নির্বাচনে তা কর্মী-সমর্থকদের মাঝে দৃশ্যমান হয়েছে। আসন্ন ইউপি নির্বাচনে এসব দ্বন্দ্ব তৃণমূলে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

তেমনটি ঘটলে সাংগঠনিক ঐক্য বিপর্যস্ত হতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন তিনি।  
 
সুদূর প্রসারী চিন্তা থেকেই দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে মনে করেন জেলার আরেক নেতা। ব্যক্তিগতভাবে দলীয় প্রতীকে স্থানীয় প্রশাসন নির্বাচনের বিরোধিতা করলেও দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই কাজ করে যাবেন তিনি।
    
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ নেতাও বলেন, এতে সবচেয়ে বেশি মুশকিলে পড়বে দলের সাধারণ কর্মী এবং ভোটাররা। দলের মনোনীত প্রার্থী তাদের পছন্দের প্রার্থী নাও হতে পারেন। এমন অবস্থায় তারা পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেবেন, না দলের প্রর্থীকে ভোট দেবেন? তাছাড়া এমন অনেক ভোটার আছেন যারা কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মী বা সমর্থক নন। তারা কেন দলীয় প্রতীকে ভোট দিতে যাবেন? প্রশ্ন রাখেন তিনি।  
 
পৌর নির্বাচনের পর দলীয় প্রতীকে আসন্ন ইউপি নির্বাচনকেও ইতিবাচক মনে করছেন সাবেক সংসদ সদস্য ও কুড়িগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. জাফর আলী। এতে তৃণমূলে সাংগঠনিক অবস্থা আরও সংহত হবে বলেই মনে করেন তিনি।  
 
কুড়িগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের এ প্রভাবশালী নেতা বাংলানিউজকে বলেন, সরকার দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচনের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা কুড়িগ্রামের মানুষ সদ্ব্যবহার করবে বলেই আমার বিশ্বাস। জেলার ৭৩টি ইউনিয়নের ৭০টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন বাকি আছে। প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে  গ্রাম, ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, উপজেলা কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে জেলা প্রার্থীদের তালিকা চূড়ান্ত করে কেন্দ্রে পাঠানো হবে। কেন্দ্র যে প্রার্থীকে মনোনীত করবে আওয়ামী লীগের সকল স্তরের নেতাকর্মী ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা সে প্রার্থীর পক্ষেই কাজ করবে।
 
জেলার প্রতিটি ইউনিয়নে গড়ে তিনজন সম্ভাব্য প্রার্থী রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে আলোচনা করে সমঝোতার ভিত্তিতে জেলা কমিটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। যেমনটা আমরা করেছিলাম কুড়িগ্রাম পৌরসভা নির্বাচনের ক্ষেত্রে। পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজিউল ইসলাম ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন দুলাল প্রার্থী হয়েছিলেন। তাদের সঙ্গে আলোচনা করার পর তারা প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়ে নৌকা প্রতীকের পক্ষে কাজ করেছিল। এমনিভাবে প্রত্যেকটি ইউনিয়নে আমরা পদক্ষেপ নেবো।
 
আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে কুড়িগ্রামের ৭০টি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রার্থীর মনোনয়ন চূড়ান্ত হবে বলেও জানান তিনি।
 
দলীয় সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি অনুষ্ঠিতব্য পৌরসভা নির্বাচনে কুড়িগ্রাম সদর, নাগেশ্বরী ও উলিপুর পৌরসভার প্রার্থী চূড়ান্ত করে কুড়িগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগ সুপারিশ পাঠায় কেন্দ্রে। কেন্দ্র নাগেশ্বরী ও উলিপুর পৌরসভায় সুপারিশকৃতদের মনোনয়ন দিলেও কুড়িগ্রাম সদর পৌরসভায় মনোনয়ন দেয় আব্দুল জলিলকে।
 
নির্বাচনে কুড়িগ্রাম সদরে কেন্দ্র মনোনীত প্রার্থী নির্বাচিত হলেও নাগেশ্বরীতে নির্বাচিত হন জাতীয় পার্টির মনোনীত আব্দুর রহমান এবং উলিপুর পৌরসভায় নির্বাচিত হন বিএনপি’র মনোনীত তারিত আবু আলা চৌধুরী।
 
ফলে কুড়িগ্রাম জেলার আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের মাঝে বারবারই ঘুরেফিরে আসছে একটা প্রশ্ন, ইউপি নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নে জেলার সুপারিশ কতটা গ্রহণযোগ্য হবে? 
 
এদিকে দলীয় পরিচয় ও প্রতীক নিয়ে বিএনপি আদৌ ইউপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কিনা সে বিষয়ে কেন্দ্র থেকে স্পষ্ট নির্দেশনা না পাওয়ায় ইউপি নির্বাচনের প্রস্তুতির ক্ষেত্রে বেশ পিছিয়ে আছে বিএনপি। এখন পর্যন্ত তারা মনোনয়ন প্রত্যাশীদের তালিকাই চূড়ান্ত করতে পারেনি।
 
ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের তালিকা তৈরির কাজ সম্পন্ন করতে উপজেলা বিএনপিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে বাংলানিউজকে জানিয়েছেন কুড়িগ্রাম জেলা বিএনপি’র যুগ্ম সম্পাদক সোহল হুসনাইন কায়কোবাদ।
 
জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিএনপি’র গ্রাম, ইউনিয়ন কমিটি সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকা তৈরিসহ প্রাথমিক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। কেন্দ্রের নির্দেশনা পেলে উপজেলা বিএনপি’র সুপারিশ নিয়ে জেলা কমিটি মনোনয়ন সুপারিশ চূড়ান্ত করে তা কেন্দ্রে পাঠাবে।
 
দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচন নিয়ে দলের মধ্যে মতপার্থক্য আছে কিনা জানতে চাইলে কুড়িগ্রাম বিএনপি’র এ নেতা বলেন, আমাদের মধ্যে এ ধরনের কোনো সমস্যা নেই। পৌর নির্বাচনে কেন্দ্র সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে যাওয়ার, সে অনুযায়ী কুড়িগ্রাম জেলা বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। এখন দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচন ঝুকিঁপূর্ণ মনে করে যদি কেন্দ্রীয় বিএনপি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ায় তাহলে কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অনুয়ায়ীই সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমাদের।
 
নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর প্রশ্ন আসছে কেন প্রশ্নের জবাবে কায়কোবাদ বলেন, এ সরকারের অধীনে সব নির্বাচনই সমস্যা। ভোটের যে অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে, তেমনটা হলে তা মোকাবেলা করা খুব কঠিন হবে। তবে সুষ্ঠু ভোট হলে সদরের ৮টি ইউনিয়নের মধ্যে ৭টিতেই বিএনপি প্রার্থী জয়ী হবে বলে মনে করেন তিনি।
 
এ জেলায় জাতীয় পার্টির জেলাভিত্তিক তেমন রাজনৈতিক কর্ম তৎপরতা নেই বলে স্থানীয় কোনো নেতার সঙ্গেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। দু’একটি উপজেলায় জাতীয় পার্টির কর্ম তৎপরতা থাকলেও তা উপজেলা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ বলে জানা গেছে।
 
সদর উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের মধ্যে কাঠালবাড়ী ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আমান উদ্দিন আহমেদ মঞ্জু মনে করেন দলীয় প্রতীকে মনোনয়ন পেলে এবারও তিনিই নির্বাচিত হবেন।
 
বর্তমান এ চেয়ারম্যানের বক্তব্য, আমি আওয়ামী লীগ করি, মানুষ তা জেনেই আমাকে নির্বাচিত করেছে। তাই দলীয় প্রতীকে নির্বাচন আমার জন্য কোনো সমস্যা না। নৌকা প্রতীকেও এলাকার মানুষ আমাকে ভোট দেবে বলে আশা করি।
 
এলাকায় জোরালোভাবে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু না হলেও এক ধরনের আবহ তৈরি হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমার ইউনিয়নে আমি ছাড়া দল থেকে আরও কেউ মনোনয়ন প্রত্যাশী থাকতে পারেন। তবে অভিজ্ঞতা, যোগ্যতার বিবেচনায় এবারও আমিই মনোনয়ন পাবো বলেই আমার বিশ্বাস।         
 
জেলার ফুলবাড়ি উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়ন ঘুরে এবং খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার ৬ টি ইউনিয়নের সবক’টিতেই আওয়ামী লীগ, বিএনপির কমপক্ষে তিনজন করে মনোনয়ন প্রত্যাশী প্রার্থী রয়েছেন। তবে এলাকার বেশিরভাগ মানুষই এখনও জানেন না কবে ভোট বা কে কে প্রার্থী।
 
ফুলবাড়ী উপজেলায় জাতীয় পার্টি ও বিএনপি’র সাংগঠনিক কাঠামো নেই বললেই চলে। তার পরেও তিনটি ইউনিয়নে জাতীয় পার্টির প্রার্থী রয়েছেন। বিএনপি’র সে অবস্থান টুকুও বর্তমানে নেই। তবে আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ে সাংগঠনিক কাঠামো খুবই শক্তিশালী হওয়ায় প্রতিটি ইউনিয়নে একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশী রয়েছেন।
 
জাসদের একজন প্রার্থী পাওয়া গেলেও মহাজোটের শরিক বাম দল ওয়ার্কার্স পার্টি বা অন্য কোনো দলের প্রার্থীর কথা শোনা যায়নি। তবে নিবন্ধন বাতিল হলেও জামায়াতে ইসলামী থেকে দুইজন প্রার্থী আসন্ন নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে অংশ গ্রহণ করবেন বলে জানা গেছে। উপজেলার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে এ সব তথ্য পাওয়া যায়।   
 
আগামী মার্চ থেকে কয়েক ধাপে ইউপি নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশন (ইসি) এ নির্বাচন আয়োজনে প্রস্তুতি শুরু করেছে। চলতি মাসেই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হতে পারে। এখন পর্যন্ত আইন যেভাবে আছে, তার কোনো পরিবর্তন না হলে দলীয় প্রতীকে কেবল চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন হবে। অন্য পদে নির্বাচন হবে নির্দলীয় ভিত্তিতে।
 
২০১১ সালে প্রথম ধাপে মার্চ-এপ্রিল মাসে ৫৩৮টি ইউপিতে নির্বাচন হয়েছিল। এরপর মে মাসে ১৩৪টি, জুন মাসে ৩ হাজার ১৫২টি, জুলাই মাসে ৪০৮টি এবং ১ আগস্ট থেকে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে ৩৪টি ইউপিতে নির্বাচন হয়েছিল। এর বাইরে ২০১২ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে মেয়াদ শেষ হওয়ায় ১১২টি ইউপিতে নির্বাচন করা হয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৪১৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২, ২০১৬
এমএইচপি/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।