ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

গ্লানি মুছে বর্ণিল হচ্ছে দাসিয়ার ছড়া

মেহেদী হাসান পিয়াস | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪৪৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৩, ২০১৬
গ্লানি মুছে বর্ণিল হচ্ছে দাসিয়ার ছড়া ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

দাসিয়ার ছড়া (ফুলবাড়ী, কুড়িগ্রাম) থেকে: প্রায় ছয় যুগের আত্মপরিচয়হীনতা ঘুচিয়ে ছয় মাসেই বর্ণিল রূপ নিয়েছে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার অধুনালুপ্ত ছিটমহল দাসিয়ার ছড়া।

আত্ম প্রতিষ্ঠার অধিকার ফিরে পেয়ে যেন প্রাঞ্জল হয়ে উঠেছে দাসিয়ার ছড়াবাসী।

ধারাবাহিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রতিদিন বদলে দিচ্ছে তাদের জীবনমান ও বোধ।

অভাব-দৈন্য আর উত্তরবঙ্গের তীব্র, রুক্ষ শীতকে পরাজিত করে দাসিয়া ছড়ার মাটিতে এখন কেবলই জন্ম নিচ্ছে স্বপ্ন ও সম্ভাবনা। ৬৮ বছরের আত্মপরিচয়হীনতার গ্লানি, অপমানের ছোপ ছোপ দাগ মুছে ফেলে এ জনপদের মানুষগুলোর চিত্ত যেন ক্রমশ ভয়হীন হয়ে উঠছে। শির উঁচিয়ে জানান দিচ্ছে অধিকার বোধের।

সোমবার (১ ফেব্রুয়ারি) দাসিয়ার ছড়া ঘুরে এমন পরিস্থিতির কথাই জানা গেলো। মোট ১ হাজার ৬৪৩.৪৪ একর পরিমাণ এলাকার ফসলের মাঠে রবি শস্যের সবুজ ফলন, শ্রমজীবী মানুষের কর্মব্যস্ততা, শিক্ষিত তরুণদের উদ্যোগ, সরকারি-বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর জীবনমান উন্নয়নের প্রচেষ্টা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সতর্ক অবস্থান এক বিশাল কর্মযজ্ঞে পরিণত করেছে দাসিয়ার ছড়াকে।

দাসিয়া ছড়ার কালির হাট বাজারে গেলেই যে কারো চোখে পড়বে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক্সস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রকল্পের  ডিজিটাল সাব সেন্টার। যেটি গত বছরের ১৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর দাসিয়ার ছড়া সফরের পর ২১ আগস্টেই উদ্বোধন করা হয়।

মূল রাস্তার (পাকা) দুই পাশে গড়ে ওঠা কালিহাট বাজারে যাওয়ার আগেই হাতের ডান দিকের রাস্তা ধরে (কিছুদিন আগেও এ রাস্তাটি ছিল না) এগুলেই দেখা মিলবে অজগর সাঁপের মত এঁকেবেঁকে চলা নীলকমলের। মূলত এটি একটি খাল। যদিও স্থানীয় লোকেরা একে বলে নীলকমল নদী। এই নীলকমলের জলজ বুকের ওপর দিয়ে রাস্তা বরাবর পাশাপাশি দু’টি উচুঁ-নিচু সাঁকো। সাঁকো বললে খানিকটা ভুল হবে। বলা যায়, বাঁশ-চাতাইয়ের কালভার্ট।

যার ওপর দিয়ে অনায়াসে বাইসাইকেল, রিকশা, ভ্যান, মোটরবাইক চালিয়ে এপার-ওপার যাওয়া যায়। পারাপারের অনুন্নত ব্যবস্থা মনে হলেও নান্দনিকতায় অনন্য বলতেই হবে। দুই পাড়ের বাসিন্দাদের অনেককেই নীলকমলের জলেই গোসল ও ধুয়ামমুছার কাজ করতে দেখা যায়।

নীলকমল ডিঙিয়ে আরেকটু সামনে এগুলেই দাসিয়ার ছড়াবাসীর অধিকার আন্দোলনের এক নেতার বাড়ি। নাম তার আলতাফ হোসেন। বর্তমানে দাসিয়ার ছড়া আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক। সাবেক ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির দাসিয়ার ছড়া শাখার সভাপতিও তিনি। উঁচু কালো গড়ন মানুষটির বিনয়, আতিথেয়তায় যে কেউ মুগ্ধ হতে বাধ্য।

এ নেতার বাড়িসহ আশেপাশের কয়েকটি বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ রয়েছে। অচিরেই দাসিয়ার ছড়াসহ বিলুপ্ত হওয়া সব ক’টি ছিটমহালের ঘরে ঘরে বৈদ্যুতিক পাখা ঘুরবে, বাতিও জ্বলবে। সংযোগ স্থাপনের কাজ পুরোপুরই সম্পন্ন। এখন শুধুই উদ্বোধনের অপেক্ষা।

বাংলানিউজকে এমনটাই জানালেন কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক খান মো. নুরুল আমিন। দিন-তারিখ ঠিক না হলেও চলতি মাসের মাঝামাঝি সময়ে কোনো একদিন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী কিংবা সচিব এ বিদুৎ সংযোগের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন বলেও জানান তিনি।

দাসিয়ার ছড়ার বাঁশ, কাঠ ও ছনের ঘরগুলো সাঁপের মতো খোলস পাল্টে টি এবং ইট-কাঠের হয়ে উঠছে। বিগত ছয় মাসে এর সংখ্যা নেহাত কম নয়।

আলতাফ হোসেন জানালেন, মূল ভূ-খণ্ডে একীভূত হওয়ার পর দাসিয়ার ছড়ায় টিনের দু’চালা পাকা ঘর উঠেছে কমপক্ষে ৩০টি। টিন, ইট-কাঠের নতুন ঘরগুলো চোখে পড়ের মতো।

শুধু কি অবকাঠামোগত পরিবর্তন? শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সম্প্রীতি, শিষ্টাচার ও সামাজিকতাতেও বইছে দারুণ পরিবর্তনের হাওয়া। অবাক করার মতোই তথ্য দিলেন আলতাফ হোসেন। তিনি জানালেন, গত ছয় মাসে কমপক্ষে দুইশো’ বিয়ে হয়েছে এক দাসিয়ার ছড়াতেই। মনস্তাত্বিক পরিবর্তনের উদাহরণ হিসেবে এর চেয়ে ভালো নিয়ামক আর কী হতে পারে?

ধরে নেওয়া যাক তিনি বাড়িয়ে বলেছেন। এক চতুর্থাংশও যদি ঘটে থাকে তাহলেই বা কম কিসে? একটি এলাকায় ছয় মাসে ৫০টি বিয়ে তো নিশ্চিতভাবেই একটি রেকর্ড।

এখানেই শেষ নয়। শিক্ষাসহ সব নাগরিক সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত এ জনপদের কামারপুর, কালিরহাট, বালাটারিতে তিনটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। নিঃসন্দেহে ভালো একটি খবর। তার চেয়েও ভালো খবর হলো, দাসিয়ার ছড়ার শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বালক-বালিকাদের জন্য গড়ে উঠেছে দু’টি আলাদা নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসা।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার অর্থায়নে প্রায় সম্পন্ন একটি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ও গড়ে উঠেছে। স্থানীয় শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা বিনা পারিশ্রমিকে স্কুল দু’টিতে শিক্ষকতা করছেন। তাদের এই প্রত্যয়ী ভীতেই একদিন গড়ে উঠবে দাসিয়ার ছড়ার গর্বিত প্রজন্ম।

বর্তমান নাগরিক অধিকার সমন্বয় কমিটির যুগ্ম-আহ্বায়ক ও সাবেক ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহাল মিনিময় কমিটির বাংলাদেশ শাখার সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফার আরজি জানান, গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় নতুন করে পাঠদানের অনুমতি না দেওয়ার যে ঘোষণা দিয়েছে। সে ঘোষণার আওতায় সম্প্রতি দাসিয়ার ছড়ায় গড়ে উঠা বিদ্যালয়গুলোকে বিবেচনা না করা হয়।

৬৮ বছরের আত্মপরিচয়ের সংকট থেকে মুক্ত হওয়ার পর বঞ্চিত এই মানুষগুলোর মধ্যে যে প্রাণ ও গতির সঞ্চার হয়েছে, সরকারের নানা শর্ত-সিদ্ধান্ত তাদের জন্য শিথিল না করলে, বিশেষ প্রণোদনা না দিলে দাসিয়ার ছড়াবাসীদের পক্ষে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ সময়: ০৪২১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৩, ২০১৬/আপডেট: ১০১৭ ঘণ্টা
এমএইচপি/বিএস/টিআই

** আ. লীগের জোরালো প্রস্তুতি পিছিয়ে বিএনপি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।