ঢাকা: পাল্টাপাল্টি দুই কূটনীতিক প্রত্যাহারের পর এবার হাইকমিশনের কর্মী ‘আটক’ এর ঘটনায় আবারও উত্তপ্ত ঢাকা-ইসলামাবাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক। গত সোমবার ঢাকায় পাকিস্তান হাইকমিশনের এক কর্মীকে আটক করার পরপরই ‘প্রতিশোধ’ স্বরুপ ইসলামাবাদে বাংলাদেশ হাইকমিশনের এক কর্মীকে আটক করা হয়।
পাকিস্তান সিকিউরিটি’র শিকার জাহাঙ্গীর হোসেন মঙ্গলবার পুরো ঘটনা জানিয়ে বাংলাদেশ হাইকমিশনার সোহবার হোসেন বরাবর একটি প্রতিবেদন জমা দেন।
ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইসলামাবাদে বাংলাদেশ হাই কমিশনের পার্সোনাল স্টাফ (পিও) জাহাঙ্গীর প্রতিদিনের মত গত সোমবার (১ ফেব্রুয়ারি) তার বড় মেয়েকে কোচিং থেকে আনতে সন্ধ্যা ৬টার দিকে অফিস থেকে মোটরসাইকেল নিয়ে বের হন। কিন্তু হঠাৎই কয়েকজন তার পথ অবরোধ করে। সেখান থেকে ‘সিকিউরিটি’ পরিচয়ধারী লোকগুলো তাকে তুলে নিয়ে যায়।
জাহাঙ্গীর জানান, আটক করার আগে সন্ধ্যা সাড়ে ছটার দিকে তার মোবাইলে ফোন করে বাংলাদেশের ভিসা এবং ভিসা কাউন্টার খোলার সময়সূচি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। প্রশ্নকারী সাংবাদিক কি না জানতে চাইলে ওই ব্যক্তি নিজেকে সাংবাদিক নন জানিয়ে জাহাঙ্গীরের অবস্থান জানতে চান।
জাহাঙ্গীর ঘটনাটিকে জটিল হিসেবে না নিয়ে স্বাভাবিকভাবে মোটরসাইকেল নিয়ে মেয়ের কোচিংস্থলে যান। এরমাঝে তার পথ অবরোধ করে একটি প্রাইভেট গাড়ি। গাড়িটি থেকে তিন-চারজন লোক বেরিয়ে এসে তার পরিচয়পত্র দেখতে চান। জাহাঙ্গীর পাল্টা তাদের পরিচয় জানতে চাইলে তারা নিজেদেরকে সাদা পোশাকধারী সিকিউরিটির লোক বলে পরিচয় দেন।
জাহাঙ্গীর নিজের পরিচয়পত্র দেখালে একই পরিচয়পত্র একজন আফগান ব্যবহার করেন-এমন অযুহাত দেখিয়ে তাকে তাদের সঙ্গে যেতে বলা হয়। বাংলাদেশি কর্মকর্তা যেতে অস্বীকার করলে জোর করে তাকে গাড়িতে তুলে নেওয়া হয়।
এরপর তার সঙ্গে আরো রুঢ় ব্যবহার করে পাকিস্তানিরা। কিছুদূর যেতেই জাহাঙ্গীরের হাতে ওঠে হাতকড়া। শুধু তাই- নয় মাথায় কালো টুপি দিয়ে পুরো মুখ ঢেকে দেওয়া হয়। আরো কিছুক্ষণ গাড়িটি চলে। এরপর থেমে দূতাবাসে জাহাঙ্গীরের পদ ও তার কাউন্সিলরের নাম জিজ্ঞেস করা হয়।
এসব তথ্য নেওয়ার প্রায় দুই ঘণ্টা পরে আটককারীরা জাহাঙ্গীরকে তার সবকিছু ঠিক আছে জানিয়ে ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে আশ্বস্ত করে। তার হাতকড়া খুলে দিয়ে তাকে নিয়ে গাড়ি চালানো শুরু করে।
স্থানীয় সময় রাত ১২টার কিছু পরে মোটরসাইকেল, মোবাইল, আইডি কার্ড বুঝিয়ে দিলে রাত একটার দিকে জাহাঙ্গীর নিরাপদে বাসায় ফিরে আসেন।
ওদিকে বাবাকে না পেয়ে তার মেয়ে বাসায় ঘটনাটি জানায়। পরে বাসার লোকজন তাকে কোচিং থেকে নিয়ে আসে। এবং তখন থেকেই জাহাঙ্গীরের খোঁজ চলতে থাকে।
এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে তলব করে দীর্ঘ সময় জাহাঙ্গীরের আটক থাকার বিষয়টি জানতে চায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
এদিকে সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে ঢাকাস্থ পাকিস্তান হাইকমিশনের প্রেস শাখার কর্মী আবরার আহমেদ খানকে আটক করে বাংলাদেশের গোয়েন্দা পুলিশ। ঘটনার পরপরই হাই কমিশনার সুজা আলম পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি জানান। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাকে আশ্বস্ত করে। এরপর হাইকমিশনের মুচলেকার বিনিময়ে সন্ধ্যায় ওই কর্মচারীকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
কিন্তু তারপরেও রাত নয়টার দিকে আববারকে আটকের প্রতিবাদ জানিয়ে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে পাকিস্তান হাইকমিশন। তাতে বলা হয়, ‘অপবাদ ও মিডিয়া ট্রায়ালের’ পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান হাই কমিশনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের এভাবে হেনস্তা করার এই ধরনটি দেখা যাচ্ছে।
এদিকে পাকিস্তানের এমন আচরণের প্রতিবাদে ঢাকাস্থ পাকিস্তানি হাইকমিশনার সুজা আলমকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদলিপি দেওয়া হয়।
মঙ্গলবার দুপুরে প্রায় একঘণ্টার বৈঠকে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব খোরশেদ আলম এবং সচিব (দ্বিপাক্ষিক) মিজানুর রহমান তাকে বাংলাদেশের অসন্তোষের কথা জানান।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আবরারকে ধরার পরে সুজা আলম পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করলে তাকে আশ্বস্ত করা হয়, এমনকি সন্ধ্যায় তাকে ছেড়েও দেওয়া হয়। তারপরেও দেশটির হাইকমিশন সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে- যা মোটেই ভালভাবে দেখেনি বাংলাদেশ। এছাড়া অযৌক্তিক কারণে পাকিস্তানে বাংলাদেশি কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর হোসেনকে আটক করে পাকিস্তানি সিকিউরিটি’রা। এ দুটি ঘটনার কারণ জানতে চেয়েছে বাংলাদেশ। কড়া প্রতিবাদ জানিয়ে চিঠিও দিয়েছে।
পাকিস্তান হাইকমিশনারকে তার কর্মী আটকের ব্যাখ্যাও দিয়েছে বাংলাদেশ। যেখানে বলা হয়েছে— কয়েক মাস ধরেই আবরার বাংলাদেশের গোয়েন্দা নজরদারিতে ছিলেন। তার মোবাইল ফোন ট্র্যাক করে দেখা গেছে, তিনি দিনের বেশিরভাগ সময় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আশপাশে ঘোরাঘুরি করছিলেন।
এছাড়া, ভিয়েনা কনভেনশন অনুসরণ করে ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ একটি সার্কুলার জারি করে। যেখানে বলা আছে, যেকোনও ডিপ্লোম্যাটিক যান্ত্রিক বাহনের (গাড়ি, মোটরসাইকেল ইত্যাদি) ডিপ্লোম্যাটিক নম্বর প্লেট থাকতে হবে। কিন্তু তার মোটরসাইকেলের ডিপ্লোম্যাটিক নম্বর প্লেট ছিল না।
বৈঠক শেষে সুজা আলম সাংবাদিকদের বলেন, ইসলামাবাদে বাংলাদেশি আটকের ঘটনাটি আমাকে জানানো হয়েছে। আমি এ বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে বিস্তারিত জানাবো।
তবে এ ঘটনা দুদেশের সম্পর্কে কোন প্রভাব ফেলবে না জানিয়ে পাকিস্তানের হাইকমিশনার বলেন, আগামী দিনগুলোতে এই সম্পর্কের আরও উন্নতি হবে বলে আমার প্রত্যাশা।
বাংলাদেশ সময়: ১০৪০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২, ২০১৬
জেপি/জেডএম