ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

শুক্রবারের স্পেশাল রিপোর্ট

বৈঠায় বাঁধা রাতের জীবন

ইকরাম-উদ দৌলা, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮১৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৫, ২০১৬
বৈঠায় বাঁধা রাতের জীবন ছবি: আনোয়ার হোসেন রানা/বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: দেশে উন্নয়নের ছোঁয়ায় প্রায় সব নদীর উপরেই ব্রিজ হয়েছে। খালগুলোও হয় ভরাট হয়েছে, নয়তো ওগুলোর উপরে তৈরি হয়েছে সেতু।

ফলে এদেশীয় সংস্কৃতির এক অনন্য স্বাক্ষর খেয়া পারাপার বেশির ভাগ জায়গায় নেই বললেই চলে।
 
তবে কোথাও আবার এই খেয়া পারপারের বিষয়টি এখনো আগের মতই রয়ে গেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের বর্তমান স্লোগানের দিনেও শেষ হয়নি যার প্রয়োজন বা আবেদন। মূলত, সময় এবং অর্থ সাশ্রয়ী হওয়ার কারণেই এখনও সেসব এলাকার জন সাধারণের পছন্দ খেয়া পারপারই। যার উপর নির্ভর করে এখনও জীবিকা নির্বাহ করছেন হাজার হাজার মাঝি।
 
রাজধানী ঢাকার এক অবিচ্ছেদ্য ইতিহাস নদী বুড়িগঙ্গা। যার এপাড়ে বর্তমানের পুরান ঢাকা, ওপারে কেরানীগঞ্জ। এককালে এই দুই পাড়ের জনপদের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিলো খেয়া পারপার। প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় বর্তমান কালে বুড়িগঙ্গার উপর দিয়ে গড়া হয়েছে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ সেতু। কিন্তু সেই খেয়া পারাপারের আবেদন এখনও আগের মতই রয়ে গেছে।

জানা গেছে, পুরান ঢাকার পাড় ঘেঁষে বুড়িগঙ্গায় অন্তত ১০টির মতো খেয়া ঘাট রয়েছে। যেগুলোতে হাজারের বেশি নৌকায় প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এপার-ওপার হচ্ছেন। আর তাদের সেবায় বংশ পরম্পরার সাথে সাথে অনেকে বাস্তচ্যুত হয়েও যুক্ত হয়েছেন খেয়া মাঝির দলে।
 
বুধবার (৩ ফেব্রুয়ারি) দিনগত রাত আড়াইটার দিকে গিয়েও দেখা মেলে অন্তত ৫০ জন মাঝিকে। যারা অবিরাম বৈঠা বেয়ে যাত্রী বোঝাই খেয়া এপার থেকে ওপারে নিচ্ছেন।
 
অনেকের সঙ্গেই কথা বলে জানা গেল, মাঝিদের বেশি ভাগেরই বাড়ি কেরানীগঞ্জ। অনেকে আবার বিভিন্ন এলাকা থেকে নদী গর্ভে ভিটে মাটি হারিয়ে কেরানীগঞ্জে ঠাঁই নিয়েছেন।
 
খেয়া মাঝি মোহাম্মদ হোসেন মিয়া জানান, প্রায় ৪০ বছর ধরে তিনি বুড়িগঙ্গায় খেয়া পারাপার করেন। এখানে বছরব্যাপী চুক্তি ভিত্তিক খেয়া নেওয়া যায়। আবার চুক্তি ছাড়াও নেওয়া যায়। এক্ষেত্রে খেয়ার মালিককে ১ বছরে প্রতিদিন ৬০ টাকা করে দিতে হয়। আর ঘাটে দিতে হয় ৮০ টাকা করে।

হোসেন মিয়া চুক্তি ভিত্তিক খেয়া নেননি। দিনে ৩০ টাকা হিসেবে তিনি খেয়া নেন মালিকের কাছ থেকে। ঘাট এবং ব্যক্তিগত খরচ বাদে দিনে এক হাজার টাকা রোজগার হয় তার।
 
তবে রোজগার ভালো হলেও নদীর দূষণ আর দখলের কথা উল্লেখ করে দুঃখ করেন তিনি। বলেন- ‘কী নদী ছিলরে! আর কী হইল! ওইপারে (কেরানীগঞ্জে) যে বাড়ীগুলান এহন দেখতাছেন, নদী তার ওইপারে আছিল। ভরাট হইয়া এখন চাইপা গ্যাছে। ’
 
বৈঠা বাইতে ভালো লাগে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,  জীবন গ্যাল তো বৈঠা বাইয়াই, এই গাডেই। বালো না লাগলে কী আর এই কাম করি! নৌকা যখন তরতর কইরা আগাইয়া যায়, তহন আনন্দ লাগে।
 
এমন সময় পুরো একটি পরিবারকেই দেখা গেল খেয়া পারাপারের জন্য আসছে। হোসেন মিয়া নৌকাখানি তীরের দিকে ভালো করে ভিড়িয়ে নিলেন, যেন তাদের উঠতে কোনো সমস্যা না হয়। দেখা গেল ওই পরিবারে একজন যুবকও রয়েছেন। নাম মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ। এতো রাতে কোথা থেকে এসেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, চীনে গিয়েছিলাম সপরিবারে ঘুরতে। বিমানবন্দর থেকে আসলাম। কেরানীগঞ্জে বাসায় যাচ্ছি।

খেয়ার মাঝি আবুল কালাম জানান, দিনে জনপ্রতি পাঁচ টাকা আর রিজার্ভ নিলে ১৫ টাকা নেওয়া হয়। আর রাতে জনপ্রতি ১০ টাকা আর রিজার্ভ ২০ থেকে ৩০ টাকায় নদী পার করে দেন।
 
যাত্রী ও মাঝিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বুড়িগঙ্গার উপর দিয়ে ব্রিজ হলেও তা জনসাধারণের কাজে আসে না। কেননা, যারা নদীর ওপাড়েই থাকেন, তারা ব্রিজ ধরে পার হলে অনেক সময় লেগে যায়। এতে খরচও বেশি হয়। আর খেয়া পারপার হতে মাত্র ১০ মিনিটেরও কম সময় লাগে। আর এজন্যই বুড়িগঙ্গার খেয়া পার‍াপার আজও টিকে আছে।
 
তবে এই খেয়া পারপারের ব্যবস্থাটির উন্নয়ন করা দরকার বলেও মনে করেন তারা। কেননা, ঘাট থেকে নীচে নেমে আসার পথটা অনিরাপদ।
 
বাংলাদেশ সময়: ০৮১৯ ঘণ্টা, ফেব্রয়ারি ০৫, ২০১৬
ইইউডি/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।