ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

‘আপনারা চাইলেই মসলিন ফিরে আসবে’

শুভ্রনীল সাগর, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩০৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৫, ২০১৬
‘আপনারা চাইলেই মসলিন ফিরে আসবে’ ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

জাতীয় জাদুঘর থেকে: বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী গ্যালারিতে এর আগে বহুবার গিয়েছি, কিন্তু এরকম ধাক্কা কখনও খাইনি। ধাক্কা মানে, চেনা এই গ্যালারিকে যেভাবে দেখে অভ্যস্থ সেভাবে না পাওয়া।

এবারের উপলক্ষ ছিলো, ‘মসলিন ফেস্টিভ্যাল-২০১৬’। নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট আনুষ্ঠানিকতা পার হয়ে ভেতরে ঢুকতেই গা ছমছমে অনুভূতি। তুলো দিয়ে পাকানো দড়ি সিলিং থেকে নিচ অব্দি সারিসারি টাঙানো। কে যেনো এলোচুল এলিয়ে দিয়েছে। আলো বলতে ওই দরজা খুললে যেটুকু ঢোকে সেটুকু। প্রেতপুরী নয়তো!

ঢুকতেই ব্যাপারটি পরিষ্কার হলো। বিষয়বস্তু সম্পর্কে ধারণা যে একেবারেই ছিলো না, তা নয়। কিন্তু এ সম্পূর্ণই ধারণাকে অতিক্রম করে যাওয়ার মতো ব্যাপার। ভেতরের প্রতিটি ইঞ্চি যেনো মসলিন আর মসলিন। প্রতিটি বিষয়কে বিষয় পরিপূরক ফুটিয়ে তুলতে একেবারে ঠিক ঠিক আয়োজন। সিনেমার ভাষায় যাকে বলে, সেট ডিজাইন।

মসলিন নামটি নিলেই প্রথম যে ধারণা মাথায় আসে, ৫০ মিটার মসলিন কাপড় ভাঁজ করে একটি দিয়াশলাইয়ের বাক্সে ভরে ফেলা যেতো। এটি সম্ভব হতো সুতার সূক্ষতার কারণে। তাঁতীরা যাকে বলেন মসলিন সুতা। এ বিশেষ সুতা তৈরি হয় ফুটি কার্পাস থেকে। যেহেতু সুতাই সব তাই প্রদর্শনী শুরু সুতা দিয়েই। বামদিক থেকে একপাশের পুরোটা দেওয়াল জুড়ে সুতা প্রস্তুত সংশ্লিষ্ট যাবতীয় বিষয়াদী। বইয়ের পাতা থেকে তাঁতীর চরকা, ইস্ট ইন্ডিয়া আমল থেকে বর্তমান সময়- বাদ যায়নি কিছুই। যেটি যেভাবে সম্ভব হয়েছে, আয়োজক পক্ষ সেটি সেভাবেই হাজির ও উপস্থাপন করেছেন। গ্যালারির মধ্যিখানে শোভা পেয়েছে মসলিনে তৈরি কাপড়চোপড়। কিছু কাচঘেরা ছোট ঘরে, কিছু ম্যানিকুইনের গায়ে- প্রত্যেকটির সঙ্গে প্রয়োজনীয় ফুটনোট।

একটি অংশে কাঠবোর্ড দিয়ে ঘিরে বসানো হয়েছে মসলিন তৈরির তাঁত। হ্যাঁ, এটিই এ প্রদর্শনীর বিশেষত্ব। চোখের সামনে তাঁতী মসলিন শাড়ি বুনছেন, এ দৃশ্য দেখাও তো সৌভাগ্যের বিষয়! এজন্য তাকে ঘিরেই সবার ভিড়।

তিনিও হাসিমুখে সবার আগ্রহ-আবদার মেটাচ্ছেন। ভিড় ঠেলে যতদূর জানা গেলো, মসলিন তৈরির মহান এ শিল্পীর নাম মো. আল-আমিন। এসেছেন নারায়ণগঞ্জ থেকে। এখন জামদানির কাজ করে ব্যবসা চললেও, পূর্ব পুরুষের কাছ থেকে মসলিন তৈরিও তার শেখা। কে না জানে, নানা কারণে বিলুপ্তপ্রায় এক ঐতিহ্যের নাম মসলিন।

মসলিন মানে যেখানে হতাশা, সেখানে আল-আমিন কিন্তু শোনালেন আশার কথাই, সরকার যদি এদিকে বিশেষ নজর দিতো তাহলে মসলিনের হারানো ঐতিহ্য ফেরানো সম্ভব। মসলিনের মূল উপাদান সূক্ষ সুতা। এটি প্রস্তুত করাও বেশ জটিল ও সময় সাপেক্ষ। এছাড়া রয়েছে উৎপাদন খরচ ও দক্ষ কারিগরের মজুরি। সবমিলিয়ে দাম পড়ে যায় অনেক। সেই দামে কেনার লোকও খুব কম। এজন্য সরকার ও সংশ্লিষ্ট মহলের এগিয়ে আসা দরকার।

তাঁতঘর থেকে বেরিয়ে চোখে পড়বে কারুকার্যময় মসলিন শাড়ি। এই সেই শাড়ি যা কিনা ভাঁজ করা অবস্থায় আংটির ভেতর দিয়ে ঢুকে যেতো! সেই আমলে নাকি আংটি পরীক্ষার মাধ্যমে আসল শাড়ি-নকল শাড়ি চেনা হতো। একবার ভাঁজ করে দেখার সাধ হলো, কিন্তু ছুঁতে মানা।

‘আপনারা একটু দ্রুত দেখে বের হলে খুব ভালো হয়। বাইরে অনেকেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন। প্রদর্শনী একমাস চলবে। চাইলে অনেকবার দেখতে পারেন’, দৃকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহীদুল আলমের কাতর অনুরোধ।

দৃকের কথা যখন এলো তখন এই ফাঁকে বলে ফেলা ভালো, যৌথভাবে প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, দৃক ও আড়ং। শুক্রবার (০৫ ফেব্রুয়ারি) বিকেল থেকে শুরু হওয়া এ প্রদর্শনী চলবে আগামী ০৩ মার্চ পর্যন্ত।

এর আগে, বিকেল ৫টায় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। সঙ্গে ছিলেন সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদু্জামান নূর, জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক ফজলুল লতিফ চৌধুরী, ব্র্যাকের সিনিয়র পরিচালক তামারা আবেদ ও দৃকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম। এসময় দৃক প্রকাশিত গ্রন্থ ‘মসলিন, আওয়ার স্টোরি’র মোড়ক উন্মোচন করা হয়।

উৎসবের উদ্দেশ্য নিয়ে সাইফুল ইসলাম আগেই বলেছিলেন, এই উৎসবের পেছনে আমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিলো, ইতিহাস মতে মসলিন তৈরিতে আমাদের দেশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সবার সামনে তুলে ধরা। মোঘল আমলে ব্যবহৃত এই ঐতিহাসিক কাপড়ের গল্পটি জানানো, এই কাপড়ের পুনরুজ্জীবনে আগ্রহ গড়ে তোলা এবং আমাদের বয়নশিল্পীদের ভূমিকা তুলে ধরাও আমাদের এই উদ্যোগের লক্ষ্য।

উৎসবকে ঘিরে মানুষের কৌতুহল ও উপচে পড়া ভিড়ের বিষয়টি শহীদুল আলমের কাতর অনুরোধেই বোঝা গেছে। ভেতরে সবাই মনোযোগী দর্শক, বাইরে আগ্রহীদের লম্বা লাইন। বেরিয়ে যেতে যেতে কথা হয় অপেক্ষারত একদল তরুণের সঙ্গে।

দলের হয়ে মতামত দিলেন ইউল্যাবের রিফাত, বইমেলা এসেছিলাম। ঢোকার আগে এই ফেস্টিভ্যালের কথা জেনেছি। আর কবে সময় পাবো, তাই আজকে আর মিস করতে চাই না।  

তাদের মতো মিস করতে না চাওয়াদের ভিড় দেখা গেলো চারপাশেই।

একেবারে বেরিয়ে যেতে যেতে মনে পড়লো মসলিন শিল্পী আল-আমিনের মুখ। বড় আশা করে এসেছেন। চোখেমুখে অন্যরকম এক তৃপ্ততা। এতো বর্ণাঢ্য আযোজন আর ক্যামেরার ঝলকানি দেখে ধরেই নিয়েছেন, মসলিনের পুনুরুজ্জীবন বুঝি হয়েই যাবে! এজন্য একই কথা বারবার বলছেন, আপনারা কিছু করেন। আপনারা চাইলেই মসলিন আবার ফিরে আসবে!

বাংলাদেশ সময়: ২৩১০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৫, ২০১৬
এসএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।