ঢাকা: কৃষি উৎপাদন বাড়লেও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা বাংলাদেশের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ। খাদ্য উৎপাদনে সঠিক জ্ঞান ও অসাধুতা এবং বাজারজাতকরণ ও বিপণনে দক্ষ ব্যবস্থাপনার অভাবে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য যোগানে অনেক পিছিয়ে।
এই সমস্যা সমাধানে কৃষির উৎপাদনে সঠিক জ্ঞান, দক্ষতা বাড়ানোর পাশাপাশি সঠিক কৃষি উপকরণে যোগান বাড়াতে হবে। কাজ করতে হবে বাজারজতকারণ ও বিপণন ব্যবস্থার উন্নতিতে। কৃষকদের কাছে তথ্য নিয়ে যেতে হবে। সব মিলিয়ে কাজ করতে হবে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, বাজার ব্যবস্থাপনা এবং কৃষিবান্ধব নীতি ও পরিকল্পনা নিয়ে।
রোববার (০৭ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁয়ে ‘ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপ বিটুইন দ্য নেদারল্যান্ডস অ্যান্ড বাংলাদেশ: ফুড সিকিউরিটি অ্যান্ড সেফটি, সেক্সুয়াল অ্যান্ড রিপ্রোডাক্টিভ হেলথ’ শীর্ষক প্রকল্প উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এমন কথা বলেন আলোচকরা।
অনুষ্ঠানের আয়োজন করে খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও), কেয়ার বাংলাদেশ এবং অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ।
অনুষ্ঠানে নেদারল্যান্ডস দূতাবাস খাদ্য নিরাপত্তার উপর দু’টি প্রকল্প উদ্বোধন এবং বিদ্যমান খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ক একটি প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ায়।
প্রকল্পগুলো হলো- মেকিং মার্কেট ওয়ার্ক ফর উইমেন (এমএমডাব্লিউডাব্লিউ), কৃষি উৎস (কেইউ) এবং এফএও ফুড সেফটি প্রোগ্রাম। কার্যকরী এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ভ্যালু চেইন তৈরির মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা বড়ানো, পর্যাপ্ত ও সুষম খাদ্য বরাদ্দ নিশ্চয়তার মাধ্যমে পুষ্টি ও স্বাস্থ্য অবস্থারও উন্নয়তির লক্ষ্য নিয়ে নেদারল্যান্ডস দূতাবাস তিনটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে।
প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করবে খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও), কেয়ার বাংলাদেশ এবং অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ। আগামী তিন থেকে চার বছর প্রকল্পগুলো পরিচালনার জন্য একশ’ ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
প্রকল্প তিনটির পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত দুই দশকে বাংলাদেশ দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। আর এর মাধ্যমে অনেক মানুষ চরম দারিদ্র্যতা থেকে বের হয়ে এসেছে। একই সময়ে কৃষিক্ষেত্রে লক্ষ্যনীয় সফলতা অর্জন এবং ধান উৎপাদনে স্বয়সম্পূর্ণ হয়েছে বাংলাদেশ। তা সত্ত্বেও এ দেশের একটি বিশাল জনগোষ্ঠী এখনো উচ্চমাত্রার অপুষ্টি ও খাদ্য ঝুঁকিতে আছে।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, আমরা খাদ্যে স্বংসম্পূর্ণ হয়েছি কিন্তু, মানুষকে নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা দিতে পারিনি। ১৬ কোটি মানুষের জন্য নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা খুবই কঠিন কাজ। নিরাপদ খাদ্য পাওয়া নিয়ে মানুষ এখন খুবই উদ্বিগ্ন। কারণ এটি স্বাস্থ্যের সঙ্গে সরসরি যুক্ত। সে কারণে সাধারণ মানুষ, উৎপাদনকারী, বাজারজাতকারীর মধ্যে উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও বিপণন নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। যে প্রজেক্ট তিনটি নেদারল্যান্ডস দূতাবাস হাতে নিয়েছে, তা এই সমস্যা সমাধানে একটি রোল মডেল হবে বলে আমি আশা করি।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে নিযুক্ত নেদারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত লিওনি মারগারেথা কিউলেনায়রি বলেন, খাদ্য নিরাপত্তা কিংবা নিরাপদ খাদ্যের জন্য উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও বিপণন ব্যবস্থায় শক্ত ভ্যালু চেইন দরকার। প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে কৃষকরা উন্নতমানের বীজ ও কৃষি উপকরণ পাবেন। এর মাধ্যমে কৃষি উদ্যোক্তা তৈরি হবে, বাড়বে নিরাপদ খাদ্য। নারীর কাজের অংশগ্রহণেরও সুযোগ বাড়বে।
অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তোফাজ্জল হোসেন বলেন, বাংলাদেশ খাদ্য চাষাবাদ ও উৎপাদনে অনেক ভালো করছে। তবে এর বাজারজাতকরণ, নিরাপত্তা বিধানে অনেক পিছিয়ে। জনস্বাস্থ্য ও জননিরাপত্তার জন্য এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করা খুবই দরকার।
আলোচকরা বলেন, কৃষির উৎপাদন, বাজারজতকারণ ও বিপণন ব্যবস্থার উন্নতি হলে খাদ্য নিরাপত্তা বাড়বে। কৃষকদের কাছে তথ্য নিয়ে যেতে হবে। যাতে করে তারা কীটনাশক ও সার ব্যবহারে সচেতন হয়। বাজার ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জানেন। সঠিক তথ্য না থাকার ফলে কৃষকরা নানা ধরনের কীটনাশক ও সার ব্যবহার করছেন। যেটি খাদ্যকে অনিরাপদ করছে।
অনুষ্ঠানে অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ’র কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির বলেন, নারীকে আরো বেশি উৎপাদন ও বাজার ব্যবস্থাপনায় যুক্ত করতে হবে। নারীর ক্ষমতায়নের জন্য আমার নারীবান্ধব কৃষি, বাজার ব্যবস্থাপনা, খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখেই কাজ করছি। নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের সঙ্গে অংশীদারিত্বমূলক প্রকল্প আমাদের উদ্যোগকে আরো উন্নত ও শক্তিশালী করবে। এছাড়া বাংলাদেশে টেকসই উন্নয়নের জন্য লিঙ্গসমতা ভিত্তিক বাজার তৈরিতে সহযোগিতা করবে এই উদ্যোগ।
কেয়ার বাংলাদেশ’র কান্ট্রি ডিরেক্টর জেমি তারজি বলেন, কৃষকরা যাতে সঠিক সময়ে সঠিক তথ্য, কৃষি উপকরণ পান সে বিষয়ে আমরা কাজ করছি। এজন্য পণ্যের ব্রান্ডিং ও বাজারজাতকরণ সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে পারবেন। কৃষি উৎস- একটি সামাজিক উদ্যোগ, যার লক্ষ্য ক্ষুদ্র কৃষক ও তার পরিবারের জন্য খাদ্যের উন্নয়ন ও পুষ্টির নিরাপত্তা। আর এ কাজটি হবে কৃষি উপাদান সংগ্রহে টেকসই দোকান স্থাপনের মাধ্যমে যেখানে উচ্চমানের উপকরণ ও সেবা প্রদানের ব্যবস্থা থাকবে। আমরা বিশ্বাস করি, এই ভ্যালু চেইনের মধ্যে এটি হবে একটি টেকসই ও রূপান্তরমূলক হস্তক্ষেপ।
অনুষ্ঠানে এফএও’র বাংলাদেশি প্রতিনিধি মাইক রবসন বলেন, বাংলাদেশে এখন নিরাপদ খাদ্য দরকার। নিরাপদ খাদ্য নিয়ে নানা মহলে নানা কথা হচ্ছে। মিডিয়ায় ফরমালিন নিয়ে লেখালেখি হলো। এতে মানুষ খাবার কেনা বন্ধ করে দিলো। এতে তারা পুষ্টি ও খাদ্য সমস্যায় পড়ছেন। নিরাপদ খাদ্য নিয়ে সঠিক তথ্য কিংবা প্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতা না থাকায় মানুষের নিরাপদ খাদ্য গ্রহণ নিশ্চিত করা যাচ্ছেনা।
স্বাস্থ্য সেবা অধিদফতরের মহপারিচালক অধ্যাপক দিন মোহা. নুরুল হক বলেন, বিশ্বব্যাপী টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার প্রথম দিকের লক্ষ্যমাত্রাগুলোর মধ্যে খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, পুষ্টির বিষয়গুলো আছে। টেকসই উন্নয়ন বলতে যা বোঝায় সেখানে নিরাপদ খাদ্য ও খাদ্য নিরাপত্তা দু’টিই দরকার। এই বিষয় দু’টি নিশ্চিত করতে না পারলে স্বাস্থ্য সমস্যা সমাধান করা যাবে না।
আলোচকরা বলেন, শাকসবজিতে বিকেলে কীটনাশক দিয়ে সকালে তা বিক্রি করছেন কৃষকরা। কেউ এটা জেনে করছেন, কেউ খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে করছেন। সেকারণেই এসব খাদ্য খুবই অনিরাপদ।
আলোচকরা বলেন, দেশের চর, হাওয়াঞ্চলসহ প্রান্তিক এলাকায় অনেক খাদ্য উৎপাদন হয়। তবে সেটি বাজার ব্যবস্থাপনার অভাবে কৃষক ন্যায্য দাম পান না। ফলে একদিকে তিনি খাদ্যে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন, অন্যদিকে আর্থিকভাবে সমস্যায় পড়েন।
এ বিষয়ে নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি লরঁ উমান্স বলেন, তিনটি প্রজেক্টে আমরা পণ্য উৎপাদন, বাজারজাতকরণ, বিপণন, পুষ্টি, নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করছি। এই পুরো বিষয়টির উন্নতি অর্থাৎ ভালো একটি ভ্যালু চেইন তৈরির জন্য আমরা কাজ করছি। এজন্য কৃষক যখন খাদ্যের মান নিয়ে সচেতন হবেন তখন খাদ্যে নিরাপত্তা বাড়বে।
অনুষ্ঠানে প্রকল্প তিনটির সংক্ষেপ তুলে ধরা হয়। মেকিং মার্কেট ওয়ার্ক ফর উইমেন প্রকল্পের মাধ্যমে অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ এসআরএইচআর এবং নির্ধারিত নারী, তাদের পরিবার এবং কমিউনিটির উন্নয়য়নে কাজ করবে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে আগামী চার বছরে ছয় হাজার কৃষি উদ্যোক্তা, ২০ হাজার কিশোর-কিশোরী, ২৭০ জন বাজার কমিটির সদস্য এবং ৪২০ জন ইউনিয়ন পরিষদের স্ট্যান্ডিং কমিটি সদস্যদের সঙ্গে কাজ করবে অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ।
কৃষি উৎস প্রকল্পে কেয়ার বাংলাদেশ খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে কাজ করবে। এজন্য প্রকল্পের ক্ষুদ্র দোকান মালিক, কৃষক ও নারী কৃষকদের নিয়ে কাজ করবে। যেখানে এদেরকে গুণগত মানের পণ্য ও সেবা দেওয়া হবে। এই প্রকল্পের আওতায় ৬৫ হাজার ক্ষুদ্র কৃষক এবং এর মধ্যে ২৬ হাজার নারী কৃষকদের নিয়ে আগামী তিন বছর কাজ করবে কেয়ার বাংলাদেশ।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে প্রকল্পটি ২০১২ সাল থেকে খাদ্য নিরাপত্তা প্রকল্পটি চালু আছে এফএও’র। যার মাধ্যমে এরই মধ্যে জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা গবেষণাগার, একটি জাতীয় খাদ্যবাহিত রোগ নজরদারি পদ্ধতি, প্রশিক্ষিত ও ভালো উৎসের খাদ্য এবং রোগ-জীবাণু পর্যবেক্ষক, ভোক্তা সচেতনতা প্রচারণা এবং মৎস্য, হাঁস-মুরগি চাষ ও ভ্যালু চেইনে স্বাস্থ্যসম্মত কৃষি সংক্রান্ত পদ্ধতির বাস্তবায়নে উল্লেখযোগ্য ফল পাওয়া গেছে।
এই প্রকল্পগুলো সপ্তম পঞ্চম বার্ষিকী পরিকল্পনা (২০১৬-২০২০), এইচপিএনএসডিপি, জাতীয় খাদ্য নীতি ও কর্ম পরিকল্পনা এবং জাতীয় পুষ্টি নীতি ২০১৫-সহ জাতীয় নীতি ও কৌশল পরিকল্পনায় অবদান রাখবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৫১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৭, ২০১৬
জেপি/জেডএস