ঢাকা: সমুদ্র জয়ের উৎসব আনন্দের পর এখনও মধুচন্দ্রিমাতেই রয়ে গেছে দেশ! ব্লু ইকোনমি নামে যে উদ্যোগ তাও অনেকটা গালভরা নামে পরিণত হয়েছে। নয়তো সেমিনার সিম্পোজিয়ামে আটকে থাকছে সমুদ্রের নীল জলরাশি আর তলদেশ থেকে অর্জিত সম্পদে জাতীয় উন্নয়ন তরান্বিত করার ধারনা।
কী হতে পারে সে উদ্যোগ? এই প্রশ্নে বিশেষজ্ঞরা জানালেন, এখনি সমুদ্র তলে জরিপ চালিয়ে নির্দিষ্ট করতে হবে সমুদ্র তলে সম্পদের পরিমান কত। বিশেষ করে মৎস্য সম্পদের জরিপ চালাতে হবে।
বঙ্গোপসাগরে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটারের বিশাল জলরাশিতে বাংলাদেশ দখল পেয়েছে ২০১২ সালের ১৪ মার্চ। এরপর ২০১৪ সালের ৯ জুলাই ভারতের সঙ্গেও বিরোধ নিষ্পত্তিতে বাংলাদেশ জিতে যায় ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকা।
দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানিয়েছে, দুই প্রতিবেশি দেশের সঙ্গে সমুদ্র সীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সমুদ্র এলাকায় মৎস্য সম্পদের আহরণে আগ্রহ দেখায় বিশ্বের বিভিন্ন নামি-দামি কোম্পানি। কিন্তু সমুদ্র এলাকায় কী পরিমান মৎস্যসম্পদ রয়েছে তার সঠিক তথ্য-উপাত্ত না থাকায় এসব বিনিয়োগকারী তাদের আগ্রহ হারিয়ে ফিরে যাচ্ছে।
অন্যদিকে, দেরি হতে থাকলে সমুদ্র তলের ভাসমান মৎস্য সম্পদের কতটুকু বাংলাদেশ তার ঝুলিতে তুলতে পারবে তা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হচ্ছে।
সমুদ্র জয়ের পর তিন বছর কেটে গেলেও এই জরিপ কেন করা সম্ভব হচ্ছে না? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে জানা গেলো এরই মধ্যে হয়ে গেছে বড় একটি ‘বোকামি’। আর তারই মাশুল গুনতে হচ্ছে সরকারকে।
বাংলাদেশ সমুদ্র জয়ের পরপরই ২০১৩ সালে ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন অব দ্য ইউনাইটেড নেশনস (এফএও) বিনাখরচে সমুদ্র এলাকার মৎস্য সম্পদের জরিপ করে দিতে চায়। কিন্তু তখন নিজেদের জরিপ জাহাজ আসবে-এমন আশায় ওই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয় বাংলাদেশ। পরে সে জরিপ জাহাজ পেতে দেখা দেয় জটিলতা। এতেই কেটে যায় দীর্ঘ সময়। অবশেষে সরকার নিজস্ব জরিপ জাহাজের পরিবর্তে এফএও দিয়েই জরিপ সম্পন্ন করানোর উদ্যোগ নেয়। তবে এখন কাজটি করে দিতে এফএও-কে মূল্য পরিশোধ করতে হবে সরকারকে। সেখান থেকেও যে আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যাচ্ছে, তা নয়!
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সবচেয়ে অগ্রাধিকার দিয়ে বাংলাদেশকে একটি জরিপ চালাতে হবে, আর তা থেকেই সুনির্দিষ্ট করা সম্ভব হবে এই বিপুল জলরাশি আর তার তলদেশে কী পরিমান সম্পদ রয়েছে। জরিপের তথ্যের ভিত্তিতেই মিলবে বিনিয়োগকারী, যারা এই সম্পদ বাংলাদেশের জন্য আহরণ করবে আর তাতেই নীল অর্থনীতি বাংলাদেশের উন্নয়নের পথে ভূমিকা রাখবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়ের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, মালয়েশিয়া থেকে জরিপ জাহাজ ‘আরভি মীন সন্ধানী’ কেনার সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেও শেষ মূহূর্তে তা নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। এতে পুরো প্রক্রিয়াটি থমকে যায়।
প্রথমেই এফএও’র প্রস্তাবে রাজি না হওয়াটা ‘বোকামি’ ছিলো বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সূত্রগুলো বলছে, জরিপ না থাকায় মৎস্য সম্পদ আহরণে আগ্রহী বিনিয়োগকারীরা যেমন ফিরে যাচ্ছেন, তেমনি পড়ে থাকা সাগর থেকে ভিন্ন দেশের জাহাজ এসে মাছও ধরে নিয়ে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে সরকারের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তাই বাংলানিউজকে জানান, সম্প্রতি মায়ানমারের ৩০ টি জাহাজ বাংলাদেশের সমুদ্র এলাকায় ঢুকে মাছ ধরে। নৌবাহিনীর সদস্যরা অবশ্য এদের মধ্যে ১২টিকে আটক করতে সক্ষম হয়, বাকি ১৮টি জাহাজ পালিয়ে যায়। আটককৃত জাহাজে বড় বড় আকৃতির সামুদ্রিক মাছ পাওয়া যায়, যেগুলো বাংলাদেশের সমুদ্র এলাকা থেকেই ধরা হয়েছে বলে স্বীকার করেন আটককৃত মায়ানমারের জেলেরা।
ওই কর্মকর্তা বলেন, এ ধরনের চুরি ঠেকাতে, আর বিপুল মৎস্য সম্পদ সুষ্ঠুভাবে আহরণ করতে সঠিক বিনিয়োগকারী প্রয়োজন। আর এসব বিনিয়োগকারী আকৃষ্ট করতে জরিপের মাধ্যমে মৎস্য সম্পদের তথ্য উপাত্ত নিশ্চিত করতে হবে।
ব্লু -ইকোনমি যেনো কোনওভাবেই গালভরা নামে পরিণত না হয়, বলেন ওই কর্মকর্তা।
জরিপ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অপর এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, প্রতিবেশি দেশ ভারত কিংবা মায়ানমার ব্লু-ইকোনমি নিয়ে অনেকদূর এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশও বিরাট সমুদ্রসীমা অর্জন করার পর বিশ্বের নামকরা কিছু প্রতিষ্ঠান মৎস্য সম্পদ আহরণে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখায়। কিন্তু এক্ষেত্রে তারা শুরুতেই এ এলাকায় মৎস্য সম্পদের তথ্য-উপাত্ত চায়। জরিপ না হওয়ায় যা আমরা সরবারহ করতে পারছি না। ফলে বিনিয়োগে আগ্রহী কোম্পানীগুলো আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। বড় অংকের বিনিয়োগের আগে সম্পদ সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, বলেন সংশ্লিষ্ট ওই কর্মকর্তা।
জরিপ চালানোর জন্য এফএও-কে নতুন করে অনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব জানানো হয়েছে বলে জানান তিনি। তবে এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত এফএও কোন উত্তর দেয়নি।
দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, রোমে এফএও’র সদর দফতরে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য ইতালিতে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাসকে অনুরোধ করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. আনিছুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এফএ্ও এখনো কোন জবাব দেয়নি, বিষয়টি তাদের বিবেচনাধীন রয়েছে। আশা করছি, খুব শিগগির তাদের ঢাকা কার্যালয়ের মাধ্যমে আমরা উত্তর জানতে পারব।
আর খরচের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জরিপ চালাতে খরচ হলেও আমরা তা বহন করার বিষয়ে প্রাথমিকভাবে সম্মত রয়েছি।
তবে একই সঙ্গে জাপান এবং ডেনমার্কের কাছেও মৎস্য সম্পদ জরিপ বিষয়ে সহযোগিতা চাওয়া হবে জানিয়ে আনিছুর রহমান বলেন, এক্ষেত্রে যারাই সহযোগিতা করতে চাইবে, বাংলাদেশ তাদের সঙ্গেই কাজ করবে।
মৎস্য বিভাগের এই অতিরিক্ত সচিব আরও জানান, শুধু একটা জরিপ জাহাজ দিয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে সাগরে মৎস্য সম্পদের তথ্য উপাত্ত জানা সম্ভব নয়। ফলে অন্যান্য দেশের বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মিলে জরিপটি করা হবে।
এ নিয়ে বাংলানিউজের কথা হয় সাবেক রাষ্ট্রদূত মহিউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, অনেক বছর পর সরকার সমুদ্রে সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছে। এই সমুদ্রের নিচে থাকা বিপুল সম্পদ দেশের অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে। তবে তা কাজে লাগাতে যে পরিমাণ দক্ষতা প্রয়োজন তা বাংলাদেশের নেই।
তিনি বলেন, প্রতিবেশি দেশগুলোর সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ শেষ হয়েছে মাত্র। খুব বেশি সময় পার হয়ে গেছে সে কথা বলবো না। তবে সময়ক্ষেপণ করাও ঠিক হচ্ছে না। এখন প্রয়োজন সমুদ্র সম্পদগুলোকে কাজে লাগানোর জন্য দক্ষ জনশক্তি তৈরি ও সঠিক পরিকল্পনা নেওয়া।
মহিউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ চলা অবস্থাতেই বিদেশি জাহাজ বাংলাদেশের চিহ্নিত এলাকা থেকে মৎস আহরণ করত। সমুদ্রে স্বার্বভৌমত্ব অর্জনের পরেও এ ধরনের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এর অর্থ- নিজেদের সম্পদ নিজেরা আহরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছি। মনে রাখতে হবে, সুযোগ সন্ধানীরা বসে থাকবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শামসুন এন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, ইতিমধ্যেই সমুদ্র তলের সম্পদ আহরণ শুরু করেছে প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মায়ানমার। বাংলাদেশও সমুদ্রে নিজেদের সীমানা বুঝে পেয়েছে তিনবছরের বেশি সময় হয়ে গেলো। অথচ সরকার এখনো সে সম্পদ আহরণে কিংবা সমুদ্র তলদেশের সম্পদ জরিপে উল্লেখযোগ্য কোন পরিকল্পনা করা যায়নি। বিষয়টি হতাশার।
তবে থেমে থাকলে চলবে না। অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে ব্লু ইকোনোমিকে জাগিয়ে তুলতে হবে, বলেন অধ্যাপক শামসুন।
স্বাধীনতার পরে ১৯৭৫ সালে এফএও পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী, বঙ্গোপসাগরে ২ লাখ ৬৪ হাজার মেট্রিক টন থেকে ৩ লাখ ৭৪ হাজার মেট্রিক টন পর্যন্ত সাদা মাছ রয়েছে। চিংড়ি রয়েছে ৯ হাজার মেট্রিক টন। তখনকার ওই জরিপে সাগরে মাছের প্রজাতি ছিল ৪৬৭টি। চিংড়ির প্রজাতির সংখ্যা ছিল ৩৬টি।
মৎস্য অধিদফতর বলছে, বঙ্গোপসাগরে প্রায় ৪৭৫ প্রজাতির মাছ রয়েছে। এর মধ্যে প্রতি বছর সাগরে ৬৬ লাখ মেট্রিক টন মাছ ধরা পড়ে। যার ২ লাখ ৯০ হাজার মেট্রিক টন মাছ ধরেন দেশের মৎসজীবীরা।
বাংলাদেশ সময়: ১০৩৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৮, ২০১৬
জেপি/এমএমকে