ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

‘পুরুষ প্রবেশ নিষেধ’ তাই বস্তি-ফুটপাতে

সাজেদা সুইটি, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫৩৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৬
‘পুরুষ প্রবেশ নিষেধ’ তাই বস্তি-ফুটপাতে ছবি: জি এম মুজিবুর/ বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

শিশু হাসপাতাল ঘুরে: ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে’, সেটিতো পড়াই আছে। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে কোনো কোনো পিতাকে কখনও থাকতে হয় হাসপাতালের ফুটপাতেও।

 
 
স্নেহময়ী মাকে নিয়ে যতো বলা ও কথা হয়, স্নেহশীল পিতাকে নিয়ে হয়তো ততো নয়। অথচ পিতারাও নিঃশব্দে ততোটাই কষ্ট সয়ে যান সন্তানের জন্য।
 
শীতের রেশ এখনও বেশ, মাঝরাতে তা আরও বাড়ে। মাঝে মাঝে চলছে আশীর্বাদের বৃষ্টিও। তবু ফুটপাতেই রাত কাটছে কিছু পিতার।
 
মঙ্গলবার (০৯ ফেব্রুয়ারি) দিনগত ‍মাঝরাত, রাজধানীর শেরে বাংলা নগরের শিশু হাসপাতালের ঘটনা। গেলেই এখানে-সেখানে দেখা মেলে তাদের। কখনো হেঁটে, সুযোগ করে একটু বসে, ঘুম ঘুম ক্লান্ত চোখ মেলে ভোরের অপেক্ষা করছেন।
 
আদরের শিশুসন্তান অসুস্থ, হাসপাতালে ভর্তি। আর যতোটা সম্ভব কষ্ট নিজের গায়েই মেখে নিতে চান এ জন্মদাতারা।
 
চাইলেই শুয়ে পড়তে পারেন না, একসময় হাসপাতালের যে স্থানগুলোতে একটু অাধশোয়া হয়ে রাত পার করা যেতো, এখন সেখানে কঠোর নিষেধাজ্ঞা।
 
শিশু হাসপাতাল চত্বরে শোয়া-বসার অনুমতি মেলে না, থাকার সুযোগ নেই। কিন্তু খুব দূরেও যাওয়া যাবে না, যেকোনো সময় শিশুর চিকিৎসায় কোনো ওষুধ বা অন্য জিনিস এনে দিতে হতে পারে।
 
কাছে হোটেল রয়েছে কিছু, কিন্তু সেগুলোতে থাকার সামর্থ্য ক’জন রাখেন? তাই রাস্তার ওপারে যক্ষা হাসপাতালের ফুটপাতে শুয়ে-বসে রাত কাটাচ্ছেন শিশু হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের পুরুষ স্বজনরা। কারণ, রাতে হাসপাতালের ভেতরে ‘পুরুষ প্রবেশ নিষেধ’!
 
মঙ্গলবারই মাগুরা থেকে লাবনী আক্তার ও তার স্বামী ১৩ দিনের কন্যাশিশুকে নিয়ে এসেছেন। শিশুটি হঠা‍ৎ কান্নাকাটি বন্ধ করে দিয়েছে। সেভাবে নড়াচড়াও করছে না।
 
হাসপাতালে সিট নেই, ভর্তি হতে হবে কেবিনে। সেখানে খরচা বেশি আসে। দিনে কমপক্ষে দুই হাজার। সেটি প্রয়োজনে তিন বা চারেও পৌঁছাতে পারে।
 
তাই সোহরাওয়ার্দীর দিকে যাচ্ছিলেন। কিছুক্ষণ পর সামর্থ্যের তোয়াক্কা না করে আবার শিশু হাসপাতালেই তাদের ঢুকতে দেখা গেলো। আর অবধারিতভাবে শিশুর বাবাসহ অন্য পুরুষ স্বজনরা কিছুক্ষণ পর আসতে বাধ্য হন খোলা আকাশের নিচে।
 
সাড়ে সাত মাসের একমাত্র সন্তান আইসিইউ’তে। বাইরে অপেক্ষায় রয়েছেন বাবা রফিকুল ইসলাম। সিরাজগঞ্জ থেকে এসেছেন তিনি। বাচ্চার হঠা‍ৎ খিঁচুনি শুরু হলে এখানে চলে আসাই ঠিক মনে করলেন।
 
কষ্টতো হচ্ছেই। বাচ্চাটা সুস্থ হলে আর এসব মনে থাকবে না। চারদিন ধরে এভাবেই কাটাচ্ছি, বাংলানিউজকে বলেন তিনি।
 
এই বাবা মনে করেন, এমন হাসপাতাল দেশে আরও প্রয়োজন। কারণ, অনেকেই সিট না পেয়ে নিরুপায় হয়ে ফিরে যান।
 
যুবক আমির হামজা এসেছেন ১০ দিন বয়সী ভাগ্নের চিকিৎসায়। বোন বাচ্চা নিয়ে হাসপাতালের ভেতরে, আর তিনি ফুটপাতে। ভাগ্নের পেটে সমস্যা, মঙ্গলবার অপারেশন হয়েছে।
 
বাংলানিউজকে আমির বলেন, হাসপাতালের সামনে থাকতে দেয় না আনসাররা। একটু আগে কতগুলা ওষুধ কিনা আনসি। দূরে গেলে বোইনে খুঁজে পাবে না, এখানেই থাকতে হবে আমার। কিন্তু তাদেরকেকে বোঝাবে। একটু পর পর ধমক দেয় আইসে।
 
যক্ষ্মা হাসপাতালে ঢোকার পথের ফুটপাতে তিনজন, আরেকটু এগিয়ে খোলা জায়গায় ১৩ জন শুয়ে। নিচে পাতলা মাদুর বা চাদর পাতা, ওপরে পলিথিন ও মশারি। মাথার কাছে কয়েলও জ্বলছে।
 
একজন বসে রয়েছেন, মাঝে মাঝে পায়চারি করছেন। তিনি এসেছেন বিক্রমপুর থেকে, নাম দেলোয়ার হোসেন।
 
বাংলানিউজকে বলেন, শুরুর দিকে কাছের বস্তিতে প্রতিরাতের জন্য ১শ টাকা করে দিতেন। কিন্তু সেটিও আজ পারছেন না। তার সঙ্গে যারা বস্তিতে ছিলেন, তাদের শিশু আরোগ্য পাওয়ায় চলে গেছেন। তিনি একা ওই বস্তিতে ভয় পাচ্ছিলেন বলে এদিকে চলে এসেছেন।
 
বলেন, বাড়িতে দোতলা বিল্ডিং আমার। আর এখানে বস্তি, ফুটপাতে আছি। আল্লাহর রহমতে বাচ্চাটা সুস্থ হোক।
 
তার বাচ্চার জন্ডিস হয়েছে। ঢাকায় আত্মীয় রয়েছেন কিছু। কিন্তু বাচ্চার রাতে কোনো প্রয়োজন হতে পারে ভেবে যান না।
 
শুয়ে থাকা একজনের দিকে দেখিয়ে দেলোয়ার বলেন, ওনার বাড়ি চাঁদপুর। বাচ্চার চিকি‍ৎসার টাকা নিয়ে আসার সময় মলম পার্টি সব টাকা নিয়ে যায়। এরপর তার ভাই এসে আবার টাকা দিয়ে গেছে। ফুটপাতে কোনোভাবে রাত কাটাচ্ছেন সবাই।
 
রফিক বলেন, এ হাসপাতালে দেশের সেরা ডাক্তাররা আছেন, খরচ কম। শুধু পুরুষদের জন্য রাতে একটু ছাদের ব্যবস্থা করলে খুব উপকার হতো। আরাম আয়েশ না, শুধু একটু জিরোনোর ব্যবস্থা।
 
দেলোয়ারও একই প্রত্যাশা করলেন, একটা ছাদের ব্যবস্থা যদি থাকতো! একটা সিসি ক্যামেরা দিয়ে লম্বা একটা জায়গা দিত, সবাই মোটামুটি মাথাটা রাখতে পারতো।
 
ফটকে কর্তব্যরত শরিফুল ও রবিন বাংলানিউজকে বলেন, কথা সত্যি। হাসপাতালের ভেতরে কোনো জায়গায় এখন পুরুষ স্বজনদের থাকতে দেওয়ার নিয়ম নেই।
 
তবে এ নিয়ম এমনি আসেনি বলেও জানান তারা।
 
হাসপাতাল চত্বরের মসজিদ ও খোলা জায়গায় যারা ঘুমাতেন, তাদের জন্য প্রায়ই সমস্যা হতো। সবাই রোগীর স্বজন ছিলেন না, কেউ কেউ বাইরের দোকানি বা হেরোইনসেবী ছিল।
 
‌কখনও কারও মোবাইল ফোন, কারও টাকা চুরির ঘটনা নিয়ে হাসপাতালে অস্থিরতা তৈরি হতো। কিছুদিন আগে মসজিদে একজনের পকেট থেকে সাত হাজার টাকা চুরি হওয়ায় ঘটনা বড় আকার নেয়। এরপর থেকে এমন নিয়মের কঠোরতা এসেছে বলে জানান তারা।
 
ভেতরের ফটকে কর্তব্যরত আকবর হোসেনও তাই জানান। চোখের ইশারায় হাসপাতালের মূল ভবনের পাশের খোলা জায়গা দেখালেন তিনি।

বলেন, আগে এখানে ঘুমাইতো অনেকে। তাদের মধ্যে কিছু খারাপ লোক ঢুকে পড়ে। হাসপাতালের যেকোনো ছোট ঘটনায় তারা বড় ঝামেলা পাকিয়ে ডাক্তারদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতেন। তাই তাদের আসা বন্ধ করা হয়েছে।
 
এমন কঠোর হতে তাদের খারাপ লাগে বলেও জানান আনসার সদস্যরা। বাইরের চোর, খারাপ লোকের কারণে এখন ভুগতে হচ্ছে রোগীর লোককে।
 
শিশু হাসপাতাল সংলগ্ন ফুটপাতে কয়েকজনের দেখা মেলে। তাদের একজন জেগে, আবুল কালাম। নিজের একটি ভ্যান ছিলো। সেটি বিক্রি করে বাচ্চার চিকি‍ৎসা করছেন। ফুটপাতে থাকা নিয়ে কষ্ট নেই মনে, কিন্তু সঙ্গের সামান্য টাকা নিয়ে দুশ্চিন্তা। চুরি হয়ে গেলেতো তার সবই গেল।
 
তিনিও বলেন, সরকার বিবেচনা করে একটা বসার জায়গা যদি দিতো রাতে, অনেক ‍উপকার হইতো।
 
বাংলাদেশ সময়: ০৫৩১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৬
এসকেএস/এসএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।