ঢাকা: দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে বিশেষায়িত জ্ঞানের বিকল্প নেই বলে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশেষায়িত জ্ঞানের যথার্থ ব্যবহার এবং সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত, সুখী-সমৃদ্ধ ‘সোনার বাংলা’ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে, এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বুধবার (১০ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর ওসমানী মিলনায়তনে মেধাবী শিক্ষার্থীদের মাঝে বঙ্গবন্ধু ফেলোশিপ ও জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি (এনএসটি) ফেলোশিপ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণায় গবেষকদের মাঝে বিশেষ অনুদানের চেক বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের ছেলে-মেয়েরা অনেক মেধাবী, আমাদের চেয়েও বেশি মেধাবী। তারা এই যুগের ডিজিটাল বাচ্চা হিসেবে বড় হচ্ছে।
শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আজকের যারা শিশু তারাই আগামী দিনে কর্ণধার হবে। আর সেটা হতে হবে আরো বেশি শিক্ষিত হয়ে, জ্ঞান অর্জন করে। জ্ঞান-বিজ্ঞান ছাড়া, শিক্ষিত জাতি ছাড়া এদেশ কোনো দিন উন্নত হবে না।
তাই অন্য কোনো দিকে মন না দিয়ে সবার আগে লেখাপড়া এবং এরপর জ্ঞান-বিজ্ঞান, খেলাধুলা ও সংস্কৃতি চর্চার দিকে শিক্ষার্থীদের মন দেওয়ার আহ্বানও জানান প্রধানমন্ত্রী।
নতুন প্রজন্মের প্রশংসা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নতুন প্রজন্ম এতোটাই প্রযুক্তিবান্ধব যে, তারা সহজেই সবকিছু শিখে যায়। মনে হয়, তারা জন্মানোর আগেই জেনে যায়, মোবাইল, ল্যাপটপ, আইপডের কোথায় কোন বাটন চাপতে হবে।
তিনি বলেন, ২০৪১ সালে আমাদের নতুন প্রজন্ম যেন উন্নত জীবন পায় সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ‘বঙ্গবন্ধু ফেলোশিপ অন সায়েন্স অ্যান্ড আইসিটি’ প্রকল্প থেকে এসব ফেলোশিপ ও অনুদান দেওয়া হয়।
প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে জানান, এ প্রকল্পের আওতায় বিদেশে ৫০ জন এমএস, ৬০ জন পিএইচডি, দেশে ১০০ জন পিএইচডি এবং ১১ জন পিএইচডি উত্তর গবেষণা ফেলোশিপ পেয়েছেন। ইতোমধ্যে বিদেশে ৩৭ জন এমএস, ৩০ জন পিএইচডি এবং দেশে ৩৮ জন পিএইচডি ও ৮ জন পিএইচডি উত্তর কোর্সে গবেষণা কার্যক্রম শেষ করেছেন।
মন্ত্রণালয় এমফিল, পিএইচডি ও পিএইচডি উত্তর শিক্ষার্থীদের ‘জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপ’ দিচ্ছে। ২০০৯-১০ থেকে ২০১৪-১৫ অর্থবছর পর্যন্ত ৪ হাজার ৮৭২ জন তরুণ গবেষকের মধ্যে ৩১ কোটি ২০ লাখ ২৬ হাজার টাকা ফেলোশিপ দিয়েছে। চলতি অর্থবছরে ১ হাজার ৪৩৮ জন গবেষককে ৮ কোটি ৩৩ লাখ ৬৩ হাজার ৩০০ টাকা দেওয়া হবে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণায় প্রণোদনা হিসেবে মন্ত্রণালয় ‘গবেষণা অনুদান’ দিচ্ছে। ২০০৯-১০ থেকে ২০১৪-১৫ অর্থবছর পর্যন্ত ১ হাজার ৩৭২টি প্রকল্পের মাধ্যমে ৫৭ কোটি ১১ লাখ ৩০ হাজার টাকা গবেষণা অনুদান দিয়েছে। বর্তমান অর্থবছরে ৩৯০টি প্রকল্পের মাধ্যমে ১২ কোটি ৮ লাখ টাকা দেওয়া হবে।
শিগগিরই বঙ্গবন্ধু ফেলোশিপ প্রকল্পটিকে ট্রাস্টে রূপান্তর করা হবে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, স্বাধীন রাষ্ট্র অর্জনে আমাদের দীর্ঘ সংগ্রামের পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সমগ্র বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।
স্বাধীন দেশের সংবিধানে শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেন বঙ্গবন্ধু। সুশিক্ষিত জাতি গড়তে শিক্ষানীতি প্রণয়নের উদ্যোগ নেন তিনি। বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড. কুদরত-ই খুদাকে প্রধান করে এ শিক্ষানীতি তৈরি করা হয়। কিন্তু পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সে শিক্ষানীতি আলোর মুখ দেখতে পায়নি।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা বঙ্গবন্ধুর সেই শিক্ষানীতির আলোকেই নতুন শিক্ষানীতি করেছি। আমরা শিক্ষাকে বহুমুখীকরণের উদ্যোগ নিয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের পাশাপাশি ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয় ও ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি প্রতিষ্ঠা করেছি।
তিনি বলেন, আমাদের দেশের ছেলে-মেয়েদের বিজ্ঞান বিষয়ক লেখাপড়ার আগ্রহ কমে গিয়েছিলো। আমরা ক্ষমতায় আসার পর শিক্ষার্থীদের সেই আগ্রহ বেড়েছে। উচ্চশিক্ষার জন্য আগে বৃত্তি দেওয়া হয়নি। আমরা সে বৃত্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি।
১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে দেখি, গবেষণার জন্য বরাদ্দ নেই। আমরা গবেষণা খাতে বরাদ্দ দিয়েছিলাম। আজকে সারা বছর তরি-তরকারি পাওয়া যাচ্ছে, এটি সে সময়কার বরাদ্দে কৃষি গবেষণার মাধ্যমেই সম্ভব হয়েছে।
অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয়, ২০০১ সালে এসে বিএনপি সেসব প্রজেক্ট বন্ধ করে দেয়। যারা বিদেশে গবেষণা করছিলেন, তাদের গবেষণাও বন্ধ হয়ে যায়।
২০০৮ সালে ক্ষমতায় এসে সবকিছু নতুন করে শুরু করতে হয়েছে বলে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এবার ট্রাস্ট গঠনসহ এমন সব পদক্ষেপ নেবো, যেন আর কেউ এসব উন্নয়ন ও গবেষণামূলক কাজ বন্ধ করতে না পারে।
তিনি বলেন, মেধা ও মনন বিকাশের সুযোগ করে দেওয়া আমাদের দায়িত্ব। আমরা সেটা করছি।
সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে বিশ্বটা কিন্তু হাতের মুঠোয়। আমরাও তার সুফলকে কাজে লাগাচ্ছি। ইতোমধ্যে সারা বাংলাদেশে ইন্টারনেট চালু করেছি। ৩৩২ কোটি ১৪ লাখ টাকা ব্যয়ে উচ্চ গতিসম্পন্ন ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিশ্বজ্ঞান ভাণ্ডারের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছি। ভার্চুয়াল প্রযুক্তিতে বিশ্বখ্যাত শিক্ষাবিদদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন এবং উচ্চশিক্ষার ডিজিটাল পুস্তক ও জার্নাল সহজলভ্য করেছি। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের গবেষণা প্রণোদনা প্রকল্প ৪৯৭ থেকে ১ হাজার ২৮২টি করেছি। ইউজিসি ২৬৭ জনকে পিএইচডি ডিগ্রি, ১৩৮ জনকে এমফিল এবং ২১ জন শিক্ষককে পোস্ট ডক্টরাল ফেলোশিপ দিয়েছে। গবেষণার জন্য সার্ক ফেলোশিপ, রোকেয়া চেয়ার ও ইউজিসি প্রফেসরশিপ প্রবর্তন করা হয়েছে। ৭শ’ ৫২ কোটি ৬৬ লাখ টাকার ‘উচ্চশিক্ষা মানোন্নয়ন প্রকল্প’ বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। উচ্চশিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ ৮৯৬ কোটি ২৬ লাখ থেকে ২ হাজার ১১৯ কোটি ৮৬ লাখ টাকা করেছি। ইউএসডিএ ও জাইকার অর্থানুকূল্যে ২ হাজার ২০০ কোটি টাকার ১৬টি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে।
দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, এটা অলৌকিক কিছু না। দেশের প্রতি ভালোবাসা, মমত্ববোধ, দেশপ্রেম থাকলে সব সম্ভব।
পদ্মাসেতু বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণ একটা টার্নিং পয়েন্ট। সবাই দেখেছে, বাংলাদেশও নিজেদের অর্থায়নে বড় কাজ করতে পারে।
বিগত সময়ে রাজনৈতিক সহিংসতার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা চাই, বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হোক। এখানে জ্বালাও-পোড়াও ধ্বংস দেখতে চাই না। সংঘাত নয়, শান্তি এটাই আমাদের লক্ষ্য।
আমাদের লক্ষ্য, বাংলাদেশকে উন্নত-সমৃদ্ধ হিসেবে গড়া তোলা বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সবাইকে নৈতিক চেতনাবোধ জাগ্রত করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা জ্ঞানের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেছেন অথবা পৌঁছাবেন তাদের বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের সঙ্গে নৈতিক চেতনাবোধ থাকা চাই। একই সঙ্গে আপনাদের ইতিহাস জানতে হবে, সমকালীন ঘটনাগুলোতে জানতে হবে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আফম রুহুল হক। স্বাগত বক্তব্য দেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব সিরাজুল হক খান।
বাংলাদেশ সময়: ১১২৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৬
এমইউএম/টিআই/এএসআর