ময়মনসিংহ: লাল মিয়াদের ৬ সদস্যের বড় পরিবারে অভাব নিত্যসঙ্গী। পরিবারের সদস্যদের মুখে দু’বেলা খাবার তুলে দিতেই রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছিলেন তার বাবা।
সপ্তম শ্রেণীর গণ্ডি পার হওয়ার আগেই বাধ্য হয়ে তাই লাল মিয়াকেই নেমে পড়তে হলো সংসারের হাল ধরতে। কিন্তু কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না।
শেষে বছর দুয়েক ইজিবাইকের চাকার সঙ্গে নিজের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে নিতে রাস্তায় নেমে পড়েন ময়মনসিংহ নগরীর কেওয়াটখালী এলাকার ২২ বছর বয়সী লাল মিয়া। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তার।
নবী হোসেন সাঈদের বয়স ১০/১২ বছর। বাড়ি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার দাপুনিয়া ইউনিয়নের সুহেলী গ্রামে। বাবা রাজমিস্ত্রি। সংসারের খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। সাঈদ এখন স্কুল ছুটি হলেই নাওয়া-খাওয়া শেষ করে প্রতিদিন বিকেলে বসে ইজিবাইকের চালকের আসনে।
তিন/চার ঘণ্টা নগরীতে ইজিবাইক চালিয়ে ৩শ’ থেকে ৪শ’ টাকা আয় করে বাড়ি ফেরে। এ টাকা তুলে দেয় মায়ের হাতে।
শুধু লাল মিয়া কিংবা সাঈদই নন, ময়মনসিংহের কয়েক হাজার তরুণ-যুবক ও বয়স্ক ব্যক্তি নিজেদের ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে চালাচ্ছেন ইজিবাইক। গত ১০ বছর ধরে সহজ এ বাহনটি নিম্নবিত্ত বেকার যুবকদের আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজেদের প্রচেষ্টায় তারা দূর করেছেন দারিদ্র্য। ঘুচেছে বেকারত্ব। ফিরিয়ে এনেছেন আর্থিক স্বচ্ছলতা।
ময়মনসিংহ পৌরসভা থেকে ৭৪৫টি ইজিবাইকের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। আর লাইসেন্সবিহীন ইজিবাইকের সংখ্যা কম করে হলেও ৫ হাজার। স্থানীয় ট্রাফিক বিভাগের তথ্য মতে, এ সংখ্যাটা হবে মাত্র দুই থেকে আড়াই হাজার।
তবে প্রতিদিন জেলার বিভিন্ন শো’রুম থেকে গড়ে রাস্তায় নামছে ১৫/২০টি ইজিবাইক। সেই হিসাবে, প্রতি মাসে গড়ে সাড়ে ৪শ’ নতুন ইজিবাইক রাস্তায় নামছে।
স্থানীয়রা জানান, কেউ কেউ পরিবেশবান্ধব ইজিবাইক ভাড়া নিয়ে চালান, অনেকে আবার কিস্তিতে কেনা এ বাহন চালিয়ে টাকা রোজগার করে মাসিক কিস্তি পরিশোধ করেন। এভাবেই নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির তরুণ-যুবকদের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা অর্জনে ভূমিকা রাখছে এ বাহন।
অল্পশিক্ষিত থেকে শুরু করে উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পার হয়েও অনেকেই ইজিবাইক চালাচ্ছেন। তাদের একজন নগরীর সানকিপাড়া শেষ মোড় এলাকার। নিজের পরিচয় গোপন রেখে তিনি জানান, ইজিবাইক চালাতে কষ্ট নেই। ভাড়াও ভালো পাওয়া যায়। প্রতিদিন গড়ে ৩শ’ থেকে ৪শ’ টাকা আয় হয়।
জানা গেছে, মহাসড়কগুলোতে ইজিবাইক চালানোর ক্ষেত্রে সরকারের বিধি-নিষেধ রয়েছে। কিন্তু তা উপেক্ষা করেও চলছে ইজিবাইক। আর এটি চলছে চালকদের জীবিকার তাড়নায় ও যাত্রীদের চাহিদায়।
ভাড়ায় ইজিবাইক চালানোর মাধ্যমে প্রতিদিন গড়ে একজন চালক ১ হাজার টাকা উপার্জন করে থাকেন। কিস্তির টাকা ও রক্ষণাবেক্ষণ বাদে গড়ে একজন চালকের ৩শ’ থেকে ৪শ’ টাকা আয় হয়। ফলে প্রতি মাসে চালকের ৯ থেকে ১০ হাজার টাকা আয় হয়। এ হিসাবে, ৫ হাজার ইজিবাইক থেকে প্রতি মাসে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা উঠছে।
নগরীর সানকিপাড়া রেলক্রসিং এলাকার ইজিবাইক চালক অসীম (৩০) ও সানকিপাড়া শেষ মোড় এলাকার রকি (২৩) জানান, তারা নিজেরাই ইজিবাইক মালিক। সারাদিন ইজিবাইক চালিয়ে সব খরচ বাদ দিয়ে প্রতিদিন তাদের পকেটে উঠছে গড়ে ৮শ’ থেকে ৯শ’ টাকা।
চালকদের অভিযোগ, ইজিবাইক চালানোর ক্ষেত্রে বিপত্তি দেখা দিয়েছে লাইসেন্স সমস্যা। যানজটের অজুহাতে বছরের পর তাদের লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে না। ফলে মাঝেমধ্যেই তাদের ওপর নেমে আসে শাস্তির খড়্গ। লাইসেন্স না থাকায় ট্রাফিক পুলিশ ইজিবাইক আটক করে। দুর্ভাগ্য বরণ করতে হয় তাদের।
চালকরা জানান, সম্প্রতি ইজিবাইকবিরোধী অভিযানে ট্রাফিক পুলিশ প্রায় ৫ শতাধিক ইজিবাইক আটক করে। সেগুলো প্রায় দু’মাস জেলা পুলিশলাইনে আটকে রাখা হয়। এতে করে অনেক ইজিবাইকের ব্যাটারি বসে অকেজো হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়।
ময়মনসিংহের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর সৈয়দ মাহাবুবুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, জেলা পুলিশ সুপার মঈনুল হকের নির্দেশে চালকদের মানবিক দিক বিবেচনা করে ১০ থেকে ১৫ দিন আগে ওইসব ইজিবাইক ছেড়ে দেওয়া হয়।
নগরীর স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ইজিবাইক নামার পর থেকে নগরীতে চুরি-ছিনতাইয়ের সংখ্যাও হ্রাস পেয়েছে। আগে দারিদ্র্য আর হতাশা থেকে বেকার যুবকরা মাদকাসক্ত হয়ে অনৈতিক পথ বেছে নিতেন। এখন ইজিবাইক চালিয়ে নিজেদের ভাগ্যবদল করেছেন। তাদের হাত হয়ে উঠেছে কর্মীর হাত।
ইজিবাইকের নিয়মিত যাত্রী রীতা খান ও ফয়সাল জানান, ইজিবাইকের কারণে যাতায়াতে সময় কম লাগছে। এছাড়া এ বাহন রিকশার চেয়েও সাশ্রয়ী। রিকশার অর্ধেক ভাড়াতেই নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৬
আরএম/এএসআর
** ফুল চাষে ভাগ্যবদল