নওয়াপাড়া (যশোর)থেকে: গ্রামের মেঠো পথ ধরে যাচ্ছিলাম। পথ প্রদর্শক অহিদুল ইসলাম (নওয়াপাড়া সরকারি মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক) হাত উচিয়ে বললেন এই সেই পুকুর, যে পুকুরে স্বর্ণপদক জয়ী মাহফুজা আক্তার শিলার দুরন্ত শৈশব কেটেছে।
কথা শুনে হয়তো অনেকের মনে খটকা লাগবে। পুকুরে আবার শৈশব কাটে কিভাবে। জলকন্যা খ্যাতি কি আর সাধে হয়েছে, সাফল্য দেবী কি আর এমনি এমনি ধরা দিয়েছে! এর পেছনে রয়েছে বিশাল সাধনা।
দুনিয়া কাঁপানো সাতারু শিলার শখ ছিলো পুকুরে সাঁতার কাটা। স্কুল কামাই দিয়ে চলতো তার সাঁতার খেলা। অনেকদিন স্কুলের বেলা গড়িয়ে গেলে জোর করে পুকুর থেকে তুলে স্কুলে পাঠাতেন মা করিমন নেছা।
অহিদুল ইসলামের কথা শুনেই সহকর্মী বাংলানিউজের সিনিয়র ফটো করেসপন্ডেন্ট দেলোয়ার হোসেন বাদল ক্যামেরায় চোখ রাখলেন। আমার মনের মধ্যেও অন্যরকম একটি ভালোলাগার আবহ ছড়িয়ে গেলো, এসএ গেমস’র স্বর্ণজয়ী শিলার স্মৃতি বিজড়িত পুকুর দেখে।
শিলাদের বাড়ি থেকে কোয়ার্টার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পুকুরটি। বাড়ি থেকে সরাসরি দেখা যায় না। মাঝে একটি বাড়ি আড়াল করে রেখেছে। শিলাদের বাড়ির দক্ষিণে একটি ফাঁকা জমির পর বাড়ি রয়েছে। আর সেই বাড়ি থেকে মিনিট দুয়েক হাঁটলে পুকুরটির ঘাটের দেখা মিলবে।
গ্রামের মেঠোপথের সঙ্গে একটি গাছের বাগান, তারপরই জলকন্যার স্মৃতি বিজড়িত মোকসেদ আলী মোল্লার পুকুরটি। যা স্থানীয়দের কাছে মোল্লার পুকুর নামে বহুল পরিচিত।
সম্ভবত বিঘা দু’য়েক হবে পুকুরটি। দেশের আর দশটি পুকুরের মতো এই পুকুরটিও তার যৌবন হারিয়ে বার্ধক্যে উপনীত হয়েছে। শান বাঁধানো ঘাটটির নিচের সিঁড়িগুলো অনেক আগেই ভেঙ্গে গেছে। অবশিষ্ট অংশে মহিলাদের কাপড় কাচতে দেখা গেলো।
টিউবয়েলের পানি লবণাক্ত হওয়ায় স্থানীয়দের প্রধান ভরসা হচ্ছে পুকুরের পানি। আর গ্রামের মধ্যে মোল্লার পুকুরের পানি তুলনামূলক ভালো হওয়ায় অনেক দূর থেকে লোকজন আসেন গোসল করার জন্য। আর ছোট ছেলে মেয়েরাও সাঁতারে হাতে খড়ি নেন এখানেই।
বর্ষা মৌসুমে সমস্যা তেমন একটা হয় না। বিড়ম্বনা দেখা দেয় চৈত্রমাসে। তখন পানি গিয়ে ঠেকে তলানিতে। তখন আর সাঁতার কাটতে দেওয়া হয় না পুকুরে। পানি ঘোলা হয়ে যেতে পারে এ কারণে। শিলার সাফল্য দেখে যারা এই পথ অনুসরণ করতে চান তাদের কাছে এই বাধা হিমালয় পর্বতের মতো।
শিলার আপন বোন মেঘলা আহমেদ তোহা (নওয়া পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী) বাংলানিউজকে জানান, আমারও সাঁতার কাটতে খুব ভালো লাগে। কিন্তু পুকুরে পানি কমে গেলে আর সাঁতার কাটতে দেয় না।
জলকন্যা শিলা নিজের দেশকে যেমন বিশ্ব দরবারে নতুন করে চিনিয়ে দিয়েছেন। তেমনি গ্রামের নতুনদের কাছে প্রেরণা হিসেব কাজ করছে। অনেকেই সাঁতারের দিকে ঝুকছে। শুধু কি নতুনদের কাছে। স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার সময় সাঁতার অন্যতম ইভেন্ট হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে।
অন্যান্য খেলায় যত প্রতিযোগী হয় তার দ্বিগুণ প্রতিযোগী অংশ নেয় সাঁতারে। যাদের সকলের কাছে এখন আইডল হিসেবে আর্বিভূত হয়েছে জলকন্যা শিলা। ক্ষুদে সাঁতারুরাও স্বপ্ন দেখেন শিলার মতো বিশ্বদরবার কাঁপানোর।
স্কুল শিক্ষক অহিদুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের বিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন ভালো সাঁতারু রয়েছে। যারা জেলার সীমানা ছাড়িয়ে বিভাগীয় পর্যায়ে খেলেছে। পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আরও অনেক ভালো খেলোয়াড় তৈরি করা সম্ভব। তাদের স্কুলে নিয়মিত সাঁতার প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।
আন্ত;স্কুল সাঁতার প্রতিযোগিতাগুলো কোথায় হয়? এমন প্রশ্নের জবাবে অহিদুল ইসলাম বলেন, স্কুলের যেহেতু পুকুর নেই, তাই আমরাও এই মোল্লার পুকুরে সাঁতারের আয়োজন করি। মোল্লা সাহেবকে বললেই তিনি পুকুর ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে দেন।
জলকন্যা শিলাকে যেমন দারিদ্র্য দমাতে পারেনি। দুর্গম সিঁড়ি বেড়ে তরতর করে উঠে গেছেন শিখরে। তেমনি তার বাবা আলী আহমদ গাজীর বিশাল হৃদয়কেও বিচলিত করতে পারেনি দারিদ্র্য।
নিজের ফসলি জমি নেই তো কি হয়েছে। স্কুলের জন্য তিন বিঘা জমি দান করে দিয়েছেন। যে জমির উপর দাঁড়িয়ে আলোক বর্তিকা ছড়িয়ে যাচ্ছে নওয়াপাড়া সরকারি মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেই স্কুলেই হাতে খড়ি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্রী এই জলকন্যা শিলারও।
অনেক গ্রামাঞ্চলে সাঁতার নিয়ে আগ্রহ না থাকলেও এই এলাকায় সাঁতার নিয়ে অবিভাবকদেরও উচ্ছাসের কমতি নেই। অনেকেই এখন স্বপ্ন দেখেন শিলার মতো তাদের সন্তানরাও স্বর্ণ নিয়ে ঘরে ফিরবে। সবার মুখে মুখে ফিরবে তার সন্তানের নাম। শিলাদের মতো তাদের বাড়ির পথেও রোডমার্ক বসবে। দলে দলে লোক আসবে এক নজর দেখার জন্য।
বাংলাদেশ সময়: ১১০৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৬
এসআই/আরআই
** ‘এতো সম্মান এইনে দেবে স্বপ্নেও ভাবতি পারিনি’