ঢাকা: বিশ্বস্ত প্রাণীগুলোর মধ্যে কুকুরের স্থান সবার আগে। তবে সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে পাগলা কুকুরের কামড় এবং পরবর্তীতে ক্ষিপ্ত জনতার কুকুরকে পিটিয়ে মারার ঘটনায় এ প্রাণীটির সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে মানুষের।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সময়মতো কুকুরকে রেভিস ভ্যাক্সিন দেওয়া হলে এবং হাসপাতাল থেকে মানুষ ভ্যাক্সিন পেলে এ দূরত্বের অবসান হবে। এরই মধ্যে ২০১০ সালের পর থেকে প্রতি বছরই কুকুরের কামড়ে মানুষের মৃত্যু সংখ্যাও কমছে।
গত ২৭ জানুয়ারি রাজশাহীর হড়গ্রাম এলাকায় পাগলা কুকুরের কামড়ে সাতজন আহত হয়েছেন। এ ঘটনার পর ওই এলাকায় কুকুর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী নিজেরাই ৪টি কুকুরকে হত্যা করেন। কামড়ে আহত শিশু হাবিবুল্লাহর মা শেফালী বেগম ছেলেকে ভ্যাকসিন দিতে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে যান। কিন্তু সেখানে ভ্যাকসিন পাননি। বাধ্য হয়ে ওষুধের দোকান থেকে চড়া দামে ভ্যাকসিন কিনে দিতে বাধ্য হয়েছেন বলে জানান তিনি।
গত ০২ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুর শহরে কুকুরের কামড়ে শিশু, নারী, বৃদ্ধসহ ১৫ জন আহত হয়েছেন। এরপর হাসপাতালে জলাতঙ্ক রোগের প্রতিষেধক না থাকায় বিপাকে পড়েন আহতরা।
হাসপাতালের জলাতঙ্ক ভ্যাক্সিন বিভাগের কর্মচারী আনসার আলী বাংলানিউজকে জানান, এর আগে একমাস ধরে হাসপাতালে ভ্যাক্সিনের সংকট ছিল।
অন্যদিকে ফরিদপুর পৌরসভা সূত্র বাংলানিউজকে জানিয়েছে, জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এক লাখ টাকা এবং চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়। অথচ পৌর কর্তৃপক্ষ গত দুই বছরেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
গত ০৪ ফেব্রুয়ারি সাভার ও ধামরাইয়ে কুকুরের কামড়ে ২২ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। এর পর পরই বেশ কয়েকটি কুকুরকে হত্যা করেন এলাকাবাসী।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সিডিসি শাখার রেভিস ভ্যাক্সিন বিভাগ থেকে জানা যায়, শুধুমাত্র জানুয়ারি মাসেই নেত্রকোনা জেলা থেকে ২ হাজারের ওপর কুকুরের কামড়ের ঘটনা এসেছে। সেখানে প্রয়োজনীয় ভ্যাক্সিন দেওয়া হয়েছে।
এসব ঘটনায় বিশ্বস্ত বন্ধু বলে পরিচিত কুকুরের সঙ্গে দূরত্ব বেড়ে চলছে মানুষের। কোনো ঘটনায় কুকুরের কামড়ে মৃত্যু না হলেও ক্ষোভে কিছু কুকুর মেরে ফেলছেন মানুষ।
হাসপাতালে রেভিস ভ্যাক্সিনের সংকটের বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের ম্যাস ডগ ভ্যাক্সিনের (এমডিভি) কনসালট্যান্ট সোহেল রানা বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের এখানে যথেষ্ট ভ্যাক্সিন রয়েছে। হাসপাতালগুলো স্বাস্থ্য অধিদফতরে ভ্যাক্সিন চেয়ে চাহিদাপত্র পাঠালে আমরা তার অনুমোদন দেই। এরপর ওষুধ প্রশাসন পরিদফতর থেকে ভ্যাক্সিন নিয়ে যেতে হয়। ভ্যাক্সিন নিতে অনেক সময় দেরি করে হাসপাতালগুলো। রাজধানীর বাইরে থেকে ওষুধ নিতে হাসপাতালগুলোর এ বিলম্বের সময়কালেই এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে সেটি প্রভাব ফেলে।
অধিদফতরের পরিসংখ্যানে জানা গেছে, ২০১০ সাল থেকে জাতীয় জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি চালু হওয়ার পর থেকে কুকরের কামড়ে মৃত্যুর সংখ্যা কমে আসছে। এর আগে প্রতি বছর জলাতঙ্ক রোগে ২ হাজার ১০০ মানুষ মারা যেতেন। ২০১১ সালে কুকুরের কামড়ে মৃত্যুর সংখ্যা ১০৯ জন, ২০১২ সালে ৮৮ জন, ২০১৩ সালে ৮৬ জন, ২০১৪ সালে ৯৭ জন এবং গত বছরে এ সংখ্যা ছিল ৬৪ জন। ২০১৪ সালের প্রথম ৫ মাসে ভ্যাক্সিনের কিছু সংকট থাকায় ওই বছর কিছু মৃত্যু বেড়ে যায় বলেও জানিয়েছে সূত্র।
জাতীয় জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় জনসচেতনতা, অবহিতকরণের ফলে কুকুরের কামড়ে মানুষের মৃত্যু সংখ্যা কমছে। এ কর্মসূচির আওতায় এক সময় কুকুর নিধনের কর্মসূচিও নেওয়া হয়েছিল। তবে ২০১৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্টের এক আদেশে কুকুর হত্যায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। এরপর গণহারে কুকুরকে টিকা দেওয়ার কর্মসূচি নেওয়া হয়। আগামী ৩ বছরে ৩ রাউন্ড ভ্যাক্সিন কর্মসূচি রয়েছে এ প্রকল্পে। এ টিকার স্থায়িত্ব ৩ বছরের মতো থাকে বলে জানান সোহেল রানা।
এছাড়াও রয়েছে কুকুরকে বন্ধ্যাকরণ কর্মসূচি। এক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে সকল জেলায় ডগ ক্যাচারদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এ কর্মসূচি সফল হলে কুকুরের প্রাদুর্ভাব ধীরে ধীরে কমবে।
এমডিভি কনসালট্যান্ট ডা. সুদেব সরকার বাংলানিউজকে বলেন, কোনো এলাকার ৭০ শতাংশ কুকুরকে এ ভ্যাক্সিনের আওতায় আনা গেলে ধারণা করা হয়, সেখানে রেভিস সংক্রমণের সম্ভাবনা কম। এরপরেও কেউ কুকুরের কামড়ে আহত হলে ভ্যাক্সিন নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির সঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় জড়িত।
বাংলাদেশে কুকুরের কামড়েই ৯৫ শতাংশ রেভিসের সংক্রমণ হয়। এছাড়া বিড়ালের কামড়ে ৩ শতাংশ এবং বেজি, ছুঁচো ও বাদুড়ের কামড়ে ২ শতাংশ রেভিসের সংক্রমণ হয়।
সোহেল রানা বলেন, সঠিক সময়ে কুকুরকে টিকা দেওয়া হলে এবং ভ্যাক্সিন সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে জলাতঙ্কে মৃত্যুর হার শূন্যে নেওয়া সম্ভব। তিনি বলেন, এ রোগে মৃত্যুর সম্ভাবনা ৯৯ শতাংশ। তবে মৃত্যুশয্যায় রোগীকে এখনো আমরা আইসিইউ’র মতো সেবা প্রদানে ব্যর্থ। এছাড়াও হাসপাতালগুলোতে ফ্যাট টেস্ট, আরটিপিসিআর এবং এলিজ টেস্টের মতো সুবিধা এখনো দিতে পারিনি।
বাংলাদেশ সময়: ১১০২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৬
এমএন/এএসআর