ফেনী: ফেনী পৌরসভার মধুপুর গ্রামের বাসিন্দা খোকন। বিদেশ ফেরত বেকার যুবক।
কিন্তু মধ্যবিত্তের সংসারে বেকারত্ব তো মহা অভিশাপ। তাই লাখ খানেক টাকা ধার-দেনা করে কিনে ফেললেন একটি ব্যাটারিচালিত ইজি বাইক (টমটম)। পরবর্তীতে এ টমটমটিই তার এবং তার পরিবারের জীবিকার একমাত্র মাধ্যমে পরিণত হয়। সারাদিন টমটম চালিয়ে যা আয় হতো তা দিয়ে সুন্দরভাবেই চলছিলো খোকনের মা-ভাই-বোন আর স্ত্রীর সংসার।
কিন্তু এ অবস্থা বেশীদিন স্থায়ী হলো না।
জেলা প্রশাসন এবং ফেনী পৌরসভা শহরের রাস্তায় ইজিবাইক (ব্যাটারি চালিত টমটম) চলাচল নিষিদ্ধ করে দেয়, পৌরসভার আর জেলা প্রশাসনের যৌথ অভিযানে বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হয় তার ও পরিবারের জীবিকার একমাত্র সম্বলটি।
আবদুল আলিম (৩৭) নামে এক চালক তো চোখের সামনে তার প্রাণপ্রিয় টমটম গুঁড়িয়ে যেতে দেখে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তার বাড়ি ফেনী শহরের বারহীপুর এলাকায়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সংসারে উপার্যনক্ষম একমাত্র আবদুল আলিমকে হারিয়ে তার পরিবার একবেলা আধ বেলা খেয়ে জীবন পার করছে।
শুধু খোকন আর আবদুল আলীম নন, বিভিন্ন সময়ে অভিযানে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে জেলার বক্তার মুন্সী এলাকার মুরাদ, চাড়িপুর এলাকার মামুন, মোর্শেদ, বারাহীপুর এলাকার হানিফ, চাড়িপুর এলাকার নয়ন, হাসান, বারাহীপুর এলাকার আবদুল আলিমসহ আরো অর্ধশতাধিক টমটম।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পরিবার-পরিজনের কাছ থেকে ধার দেনা করে কেনা জীবিকার একমাত্র মাধ্যমটি হারিয়ে আজ অনেকেই বেকার। হানিফ নামে এক টমটম চালক আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম, ভিক্ষাও করণ যাইব না।
এদিকে নিষেধাজ্ঞা স্বত্ত্বেও জীবিকার তাগিদে অনেকেই এখনো চালান ব্যাটারি চালিত তিন চাকার এ যান। তবে এ জন্য তাদের গুণতে হয় বাড়তি টাকা, পদে পদে শিকার হতে হয় হয়রানির। ইচ্ছে হলেই পুলিশ ধরে নিয়ে যায় থানায়।
আব্বাস নামে এক চালক বলেন, শহরের ভেতরে টমটম চালাতে বিভিন্ন স্থানে অন্তত পঞ্চাশ টাকা চাঁদা দিতে হয়। আর পুলিশে ধরলে তো কথাই নাই।
এদিকে ফেনী শহরে জানযট নিরসনে পৌরসভা টমটম বন্ধ করে দিলেও চাঁদা তুলছে রাস্তায় চলাচলকারী টমটম থেকে। এক টমটম চালকের কাছে পৌরসভার চাঁদা আদায়ের একটা রশিদও পাওয়া গেলো। আরো পাওয়া গেলো টমটম ইজারাদার ড্রাইবার সমিতি নামে একটি সংগঠনের চাঁদা আদায়ের রশিদ।
যদিও শহরের ভেতরে টমটম চলাচলকে ইতিবাচকভাবেই দেখছে সাধারণ যাত্রীরা। তারা মনে করছেন, এ ধরনের যাববাহনে কম টাকা দিয়েই যাতাযাত করা যাচ্ছে। এতে সময় এবং টাকা দুটোরই সাশ্রয় হয়।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা সাব্বির হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, অল্প টাকা দিয়ে টমটমে চলাচল করা যায়, এতে টাকাও বাঁচে, সময়ও বাঁচে। আবার যানজটেও পড়তে হয়। এ ধরনের যানবাহন কমে গেলে রিকশাওয়ালা আর অন্য গণ-পরিবহনগুলোর অত্যাচার বেড়ে যায়। রিকশা ড্রাইভাররা দ্বিগুণ ভাডা ছাড়া নড়তেই চায় না।
ফেনী সরকারি কলেজের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র রাহুল শার্নাল জানান, তার বাসা শহরের হাসপাতাল মোড় এলাকায়। সেখান থেকে রিকশায় কলেজে আসতে ২০ টাকা ভাড়া লাগে। কিন্তু টমটমে লাগে মাত্র ৫ টাকা। তাই টমটমই পছন্দ তার। শুধু রাহুল নন, শহরের সব শিক্ষার্থীরই পছন্দ এই টমটম।
চাকরিজীবী, শিক্ষক-ছাত্র সব ধরনের যাত্রী চায় তিন চাকার যানবাহনটি চলাচল করুক। এতে যারা চালায় তাদেরও জীবিকা হবে, আবার সাধারণ জনগণও সেবা পাবে।
এ ব্যাপরে জানতে চাইলে ফেনীর ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক (টিআই) মীর গোলাম ফারুক জানান, সরকারি অনুমোদন নেই বলে জেলায় কতোটি টমটম আছে তার পরিসংখ্যান তাদের কাছে নেই, তবে ধারণা করা হচ্ছে- ফেনীতে ৮ শতাধিক টমটম চলাচল করছে। এগুলো দেখার দায়িত্ব ফেনী পৌরসভার। তারা এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবে। তবে রাস্তায় অনুমোদনহীন এ যানটির চলাচল ঠেকাতে মাঝে মাঝে অভিযান পরিচালনা করে থাকে পুলিশ।
ফেনী পৌরসভার মেয়র হাজী আলাউদ্দিন বলেন, শহরের অভ্যন্তরীণ যান চলাচলে যানজট নিরসনে এ যানটি ফেনী শহরে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ জন্য পৌরসভা বেশ কয়েকবার অভিযান পরিচালনা করেছে। পৌরসভার দৃষ্টি ফাঁকি দিয়ে হয়তো দু’একটি চলতে পারে। সেগুলোর ব্যাপারেও দৃষ্টি দেবে পৌরসভা।
ফেনী জেলা টমটম শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ খোকন জানান, এ যাবাহনগুলো বন্ধ হলে ড্রাইভারগুলো খাবে কি? সরকার যদি নিষিদ্ধই করে তাহলে কেন দেশে এগুলো আমদানি করতে দিয়েছে? আগেও আমদানি হয়েছে, এখনও হচ্ছে। ফাঁক দিয়ে যাঁতাকলে পৃষ্ঠ হয়ে মরছে গরীব মানুষ, যারা তাদের জীবনের অর্জিত সবটুকু অর্থের বিনিময়ে জীবিকার এ সম্বলটি ক্রয় করেছে।
বাংলাদেশ সময়: ১১১৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৬
জেডএম