বেদে পল্লী (সাভার) থেকে ফিরে: দেড় শ’ জন নারী। বয়স তাদের ১৫ থেকে ২৫।
এই শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা তাকে অর্জন করতে হয়েছে সেবা আর ভালোবাসার বিনিময়েই। মানুষকে ভালোবাসাটাই যেন তার নেশা। বিশেষ করে সমাজের অবহেলিত আর প্রান্তজনদের।
শক্তি বা বল প্রয়োগে নয় বরং ভালোবাসার বার্তা দিয়ে সমাজ থেকে অপরাধের অন্ধকার দূরে করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন এই পুলিশ কর্মকর্তা। যে ভালোবাসার অভূতপূর্ব জোয়ারেই ভেসে গেছে সাভারে বেদে পল্লীর অন্ধকার। প্রত্যেকের জীবনে এখন ঝলমলে আলোর হাতছানি। যে কারণে সবার জীবনে তার পরিচিতি এখন স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। পুলিশ কর্মকর্তা হয়েও ভালোবাসা আর সেবায় প্রত্যেকের হৃদয়ে উজ্জল আসন পেতেছেন পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান।
ধরা যাক রিতার কথা। বয়স আর কত! বড় জোর চৌদ্দ কী পনের। আগে গ্রামে গ্রামে গিয়ে বিক্রি করতেন তাবিজ কবজ। সাপও ধরতেন। করতেন সিঙ্গা লাগিয়ে ঝাড়ফুঁকের ব্যবসা। এভাবেই বংশ পরম্পরায় চলে আসছিল সাভারের পোড়াবাড়ি এলাকায় বেদে পল্লীর বাসিন্দা রিতাদের জীবন। কখনো ডাঙ্গায় সাপ ধরা। কখনো বা নৌকায়-নৌকায় যাযাবর জীবন। এরই মাঝে ‘বয়স’ না হতেই বিয়ে। সন্তান জন্ম। তারপর অল্প বয়সে বুড়িয়ে যাওয়া। কারো বা আবার বিপথে যাওয়া। সমাজের আয়নায় সম্প্রদায় ভিন্ন অন্য নারীদের দেখে নিজের সাথেও তুলনা করেছেন বহুবার। কতশত প্রশ্ন উঁকি দিয়েছে রিতার কিশোরী মনে।
‘আমরাও তো নারী। দেখতে শুনতেও কোনো অংশে কম নয়। িতবে আমাদের কেন এই অভিশপ্ত জীবন? কী পাপ নিয়ে জন্মেছি যে আমাদের এভাবেই বেঁচে থেকে ‘মরতে’ হবে?
সেই থেকে নিজের সঙ্গে লড়াই। যে লড়াইটা বাঁধ ভাঙার। কিন্তু লড়াইতে নামতে হলে প্রয়োজন যে শিক্ষার। ছিলে না কেবল সেটাই। তাই বেদে পল্লীতেই এতোদিন চাপা আর্তনাদ আর কষ্টে গুমড়ে মরতো রিতাদের স্বপ্নগুলো।
এরই মধ্যে একদিন যেন হতাশার আকাশে উঁকি দেয় স্বপ্নের তারাগুলো। স্বপ্নের ফেরিওয়ালা হিসেবে আবির্ভূত হন ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান। মানুষের প্রতি ভালোবাসা তার। সঙ্গে নিজের অদম্য চেষ্টা, উদ্যোগ আর আন্তরিকতায় বদলে দেন বেদে পল্লীর প্রচলিত রীতিনীতি। পাল্টে যায় চির পরিচিত দৃশ্যপট। সঙ্গে বেদে পল্লীর মানুষদের রোজকার জীবনযাত্রা। নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হয় বেদে পল্লীর বাসিন্দা বিশেষ করে নারীদের জীবনে।
‘পুলিশ দেখলে আগে আমরা ডরাইতাম (ভয় পেতাম)। অহন উনার কথা হুনলে (শুনলে) মাইয়ারা এক নজর দেহনের লাইগ্যা ছুইট্যা আহে (আসে)’।
‘উনারে বেবাকতে (সবাই) ভালোবাসে। দেখতেও নায়কের লাহান (মতো)। আবার ব্যবহারের দেবতার মতোন। ঘরে ঘরে গেলে দ্যাকবেন মাইয়ারা (মেয়েরা) উনারে কত পছন্দ করে। নিজের লগে তার ছবি তুইল্যা অনেকেই ঘরে টাঙ্গায়া (ঝুলিয়ে) রাখছে’।
‘এমুন ভালোবাসা আগে কহনো দেহি নাই’ একটানা কথাগুলো বলে যাচ্ছিলেন কিশোরী রিতা।
‘আমি একা নই। আমার সহকর্মীদের সবাই ওদের ভালোবাসে। প্রত্যেকের সহায়তা আর ভালোবাসায় অবহেলিত আর বঞ্চিত মানুষগুলোকে সমাজের মূল স্রোতে আনতে পেরেছি। চেষ্টা করে যাচ্ছি তাদের জীবন মান উন্নয়নের। এটাই আমাদের প্রাপ্তি’।
কিশোরীর ভালোবাসার জবাবে বিনয়ী উত্তর পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমানের।
দীর্ঘদিন ধরেই মাদকের আখড়া আর অসামাজিক কার্যকলাপের স্বর্গরাজ্য হিসেবে পরিচিতি ছিল এই বেদেপল্লী।
সেই জগতের মানুষদের অপরাধ ছেড়ে মূল স্রোতে আনার বিষয়টি এখনো অনেককে অবাক করে। পাল্টে যাওয়া সেই দৃশ্যপট দেখতে আসেন মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। এমনকি ভিনদেশি অতিথিদের অনেকে ছুটে আসেন এখানে।
রীতিমতো অন্ধকার ঘুচিয়ে আলোর ফোয়ারা ছুটছে যে বেদে পল্লীতে। সেখানে বিপ্লবের শুরুটাই বা কেমন ছিল? কিভাবেই বা সম্ভব হয়েছিল এই অসাধ্যকে সাধনের?
উত্তরে অতিতে ফিরে যান পুলিশ কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান।
‘মাদক ব্যবসা নির্মূলে অভিযান চালাতে গিয়েই আমাদের নজরে আসে বেদে পল্লীর অন্ধকার জগতের বিষয়টি। সাভারের বেদে পল্লীতে মাদকের বিস্তার কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছিল না। মাদক নির্মূলে শুরু হয় অভিযান। কিন্তু অভিযানের মুখে চলমান প্রেক্ষাপটে সেখানকার বাস্তবতা কোনোভাবেই মেনে নেওয়ার মতো ছিল না,’ যোগ করেন হাবিবুর রহমান।
বাংলানিউজকে তিনি জানান, বেদে সম্প্রদায়ের মানুষদের বিশ্বাস, পেশা, সামাজিক আচার, আচরণ সবই ছিল দুই হাজার বছর আগের। তারা নিজেরাও চাইছিল এই অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসতে। পারছিলো না। লক্ষ্যটা ছিল এমন যে অপরাধ নির্মূল করতে হবে। একই সাথে এই সম্প্রদায়ের মানুষদের মাদক ও অপরাধ মুক্ত করে সমাজের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। দুটাই বেশ চ্যালেঞ্জের। অনেকেই বলেছে, পুলিশ হিসেবে এটি আমাদের কাজ নয়। তার পরও আমরা মুখ ফিরিয়ে নেইনি। কারণ তারাও তো সমাজের অংশ। আমাদেরও দায়িত্ববোধ আছে এই সমাজের প্রতি।
তিনি বলেন, যাদের ছিল না সমাজ স্বীকৃত কোনো পেশা। শুরু হলো সেই বেদে সম্প্রদায়ের মানুষদের প্রথমে ভালোবাসা। তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পেশা নিয়ে শুরু হলো নানা ধরনের পরিকল্পনা। প্রথমে শুরু করলাম মাদকের কুফল, পরিণতি ও তার প্রতিকার নিয়ে কার্যক্রম। সাধারণ ক্ষমার মতো সুযোগ দিলাম। একে একে মাদকের ব্যবসা থেকে বেরিয়ে এলো অনেকেই। এরপর তাদের জীবিকা নির্বাহের বিকল্প কি হতে পারে সে বিষয়টিকে প্রাধান্য দিলাম। ক্ষুদ্র ঋনের ব্যবস্থা করে অনেককে ব্যবসায় নিয়োজিত করা হলো। অনেককে চাকুরি দেওয়া হলো। অনেককে আবার বৃত্তিমূলক আর কারিগরি প্রশিক্ষণ দেওয়া হলো। সম্প্রদায়ের মেয়েদের অধিকাংশই মাতৃতান্ত্রিক পেশা ছেড়ে দিতে আগ্রহী ছিলেন। প্রয়োজন ছিলো তাদের শিক্ষা। তাদের জন্য চালু হলো বিশেষ কোচিং সেন্টার। যুব প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শুরু হলো বেদে নারীদের জীবনমান উন্নয়নের কাজ। কারণ এই নারীদের মধ্যে বাল্য বিবাহের চল, মাতৃমৃত্যুরোধ করাটাও ছিল একটি চ্যালেঞ্জ। লক্ষ্য ছিল এই নারীদের কিছুটা শিক্ষিত ও সচেতন করা সম্ভব হলে তাদের পরবর্তী প্রজন্ম এমনিই উন্নত হবে।
এভাবে বেদে পল্লীর দেড়’শ কিশোরী ও নারীকে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের জন্য গড়ে তোলা হলো ‘উত্তোরণ’ নামের তৈরি পোশাক কারখানা। এই কারখানাই এখন ঘুরিয়ে দিয়েছে এখানকার মানুষের ভাগ্যের চাকা।
এখানেই কথা হয় রুশনী, বৃষ্টি, ইয়ানুসহ আরো অনেকের সাথে। প্রত্যেকের চোখে-মুখে ঝলক। অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তির আনন্দে তারা আজ মাতোয়ারা।
রুশনী বাংলানিউজকে জানান, আগে সিঙ্গায় ঝাঁড়ফুকের মাধ্যমে রোজগার করতাম। মাঝে এই কাজে আয় রোজগার তেমন না হওয়ায় বাড়িতেই বসে থাকতাম। এখন শেলাই মেশিনে কাজ করি।
বৃষ্টি নামে আরেক বাসিন্দা বাংলানিউজকে জানান, তিনি স্বামী পরিত্যক্ত। বেশ হতাশার মাঝে ছিলেন। এসপি হাবিবুর রহমানের মতো মানুষের ভালোবাসার দিশা না পেলে এতোদিন হয়ত আরো অন্ধকারে পতিত হতেন। পরম কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, পুলিশরা এখানে আমাদের অভিভাবক। বলতে পারেন বাবার মতো। আমাদের ভালো মন্দের সবকিছুর খোঁজ-খবর নেয় তারা।
বেদে পল্লীর বাসিন্দা লস্কর সর্দার বাংলানিউজকে জানান, এসপি হাবিবুর রহমান আমাদের জীবন পাল্টে দিয়েছেন। পৌর মেয়রকে ডেকে এনে এলাকার রাস্তাঘাট উন্নয়ন থেকে শুরু করে ঈদগাঁ মাঠের উন্নয়ন করে দিয়েছেন তিনি।
উত্তরণ নামে তৈরি পোশাক কারখানাটি পরিচালনা করেন বেদে সম্প্রদায়ের যুবক রমজান আহমেদ। বাংলানিউজকে তিনি জানান, পুলিশ দেখলে যেখানে এক সময় ভয়ে এখানকার মানুষ ছুটে পালাতো এখন এসপি হাবিবুর রহমান এসেছেন - শোনামাত্র তাকে এক নজর দেখতে নারী পুরুষ সবাই ছুটে আসেন। তার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। এই ভালোবাসা এক অভূতপূর্ব ভালোবাসা।
পাশেই থাকা এক যুবককে দেখিয়ে দিয়ে বলেন, ছেলেটি বাপ দাদার সাপ ধরার পেশা বাদ দিয়ে ফার্মেসি বিভাগে লেখাপড়া করেও চাকরি পায়নি। বেদে সম্প্রদায়ের বলে কেউ তাকে চাকরি দেয়নি। এসপি হাবিবুর রহমান তাকে খ্যাতনামা একটি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে নিয়ে গিয়ে চাকরি দিয়েছেন।
তিনি জানান, এখানকার নারীরা প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেরাই এখন উন্নতমানের সেলোয়ার কামিজ, ছায়া, ব্লাউজ তৈরি করছেন। আমরা কাপড় এনে দিই। তারা পোশাক তৈরি করেন দেন। এগুলো আবার বিভিন্ন শো রুমে নিয়ে বিক্রি করা হয়।
সাভারের স্থানীয় সংসদ সদস্য ডা.এনামুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, ভালোবেসে যে মানুষের জীবনকে কতটা বদলে দেওয়া যায়, তার প্রমাণ এসপি হাবিবুর রহমান। তিনি আসলে এখানে ভালোবাসার মাধ্যমে ঘুনে ধরা সমাজটাকেই সংস্কার করেছেন।
বেদে পল্লীর এই বদলে যাওয়া দৃশ্যপট দেখতে শনিবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে সাভারে যান পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত আইজি আবুল কাশেম।
বাংলানিউজকে তিনি জানান, এসপি হাবিবুর রহমান মানুষকে ভালোবেসে অনবদ্য এক সমাজ তৈরি করে দিয়েছেন। তার প্রতিও মানুষের যে ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা তা পুলিশের মর্যাদাকে আরো উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। বেদেপল্লীতে পরিবর্তনের যে সূচনা হয়েছে তা সত্যিই প্রশংসার। সামাজিক উন্নয়নে তার এই উদ্যোগ একটি অনন্য দৃষ্টান্ত। এভাবে সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে সমাজের জন্য একটু কিছু করতে পারলেই সমাজ বদলে যাবে।
এসপি হাবিবুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ভালোবেসে অবহেলিত আর বঞ্চিত মানুষদের আরও অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে চান। তাদের ঘিরে রয়েছে নতুন নতুন অনেক পরিকল্পনা। সমাজের অন্যদের সহায়তা পেলে সেই স্বপ্নকে আরও দ্রুত বাস্তবায়ন করা সম্ভব বলেও জানান তিনি।
‘যেখানে প্রতিষ্ঠিত হবে অপরাধমুক্ত ভালোবাসার অনন্য এক বাংলাদেশ,’ যোগ করেন হাবিবুর রহমান।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৫০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৬
জেডআর/আইএ