ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

তামাক চাষে কমছে জমির উর্বরতা, বাড়ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি

জুলফিকার আলী কানন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৬
তামাক চাষে কমছে জমির উর্বরতা, বাড়ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

মেহেরপুর: দেশের যেসব জেলায় তামাকের চাষ বেশি হয় তার মধ্যে মেহেরপুর অন্যতম। জেলার বিভিন্ন এলাকায় বিস্তীর্ণ মাঠ জুড়ে তামাক চাষ হচ্ছে।

বছরের পর বছর তামাক চাষে একদিকে যেমন বেড়েছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি অন্যদিকে কমছে এসব জমির উর্বরতা।  
 
২০১৪ সালে এ জেলায় প্রায় ৪ হাজার হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে। এ বছর তা কমে ৩ হাজার হেক্টরে নেমে এসেছে। তবে, আগে তামাক চাষ হওয়া এসব জমিতে এখন অন্যান্য ফসলের আবাদ হলেও উৎপাদন অনেকটাই কমে গেছে।

মেহেরপুর সদর উপজেলার মদনাডাঙ্গা, আমঝুপি, বারাদী, চাঁদবিল, শ্যামপুর, শালিকা, চকশ্যামপুর, নুরপুর, গাংনী উপজেলার বাওট, নওদা হোগলবাড়িয়া, বামুন্দী, দেবীপুর, করমদী, নওপাড়া, কাজীপুর, মটমুড়া, আকুবপুর, ছাতিয়ান, মুন্দা, মাঝেরগ্রাম, চরগোয়ালগ্রাম, কুঞ্জনগর, সহবাড়িয়া, মোমিনপুর, নওদা মটমুড়া, বেতবাড়িয়া, কল্যাণপুর, সাহারবাটি, চেংগাড়া, আমতৈল, মানিকদিয়া, সিন্দুর কৌটা, বাদিয়াপাড়া, ধানখোলা, মহিষাখোলা, গাঁড়াডোব, গাঁড়াবাড়িয়া, সানঘাট এবং মুজিবনগর উপজেলার মোনাখালিসহ বিভিন্ন গ্রামের বিস্তীর্ণ মাঠ জুড়ে রয়েছে তামাকের খেত।
 
মেহেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (ডিডি) এস এম মোস্তাফিজুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, চলতি বছর মেহেরপুর জেলায় ৩ হাজার হেক্টর জমিতে তামাকের চাষ হচ্ছে। গত বছর জেলায় ৪ হাজার হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছিল। কৃষকদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির কারণ এ বছর জেলায় তামাকের চাষ কমেছে বলে জানান তিনি।

তিনি জানান, তামাক চাষের ফলে জমির উর্বরতা শক্তি মারাত্মকভাবে কমে যাচ্ছে। একই জমিতে কয়েক বছর তামাকের চাষ করার ফলে জমিতে বিশেষ ধরনের আগাছা জন্মে। এ আগাছা জমিতে একবার জন্মালে সে জমিতে আর কখনো অন্য ফসল চাষ করা সম্ভব হয়না।  
 
কৃষকদের তামাক চাষে নিরুৎসাহিত করতে কৃষি অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে নানা ধরনের কাজ করা হয় বলেও জানালেন তিনি। বিভিন্ন স্থানে কৃষকদের সঙ্গে মাঠ দিবস, পরামর্শ দানসহ বিভিন্ন সময়ে কৃষকদের তামাক চাষে নিরুৎসাহিত করা হয়ে থাকে। এর কারণে গত বছরের তুলনায় এ বছর জেলাতে ১ হাজার একর জমিতে তামাক চাষ কমেছে।
 
৩ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধানের চাষ করলে প্রায় ২০ হাজার মেট্রিক টন ধান এবং গমের চাষ করলে প্রায় ১৫ হাজার মেট্রিকটন গম উৎপন্ন হতো। যা দেশে খাদ্যের চাহিদা মেটাতো ভূমিকা রাখতে পারতো বলে জানান এস এম মোস্তাফিজুর রহমান।
 
বাওট গ্রামের তামাক চাষি মহিবুল ইসলাম ও মজনুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, ঋণসহ তামাক কোম্পানির দেওয়া বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার কারণে চাষিরা তামাক চাষে ঝুঁকে পড়েছেন।
  
বিষয়টির প্রমাণ পাওয়া গেলো অপর তামাক চাষি কুঞ্জনগর গ্রামের রফিকুল ইসলামের কথায়। তিনি জানান, প্রত্যেক বছর ৭/৮ বিঘা জমিতে তামাক চাষ করেন তিনি। তামাকের সঙ্গে অন্যান্য ফসল সামান্য চাষ করেন। তামাক চাষে পরিশ্রম বেশি হলেও দাম বেশি পান বলে জানান তিনি।
 
একই কথা জানালেন হোগলবাড়িয়া গ্রামের চাষি আকরাম হোসেন। তিনি জানান, ৬ বিঘা জমিতে তামাক চাষ করছেন তিনি। এর আগের বছরে ধান চাষ করেছিলেন। ধানের দাম বেশি না পেয়ে তামাকের চাষ করছেন তিনি।  
 
তিনি আরও জানান, তামাক কোম্পানির দেওয়া শর্ত মেনে তিনি অগ্রিম সার ও কীটনাশক পেয়েছেন। তাই তামাক চাষ করছেন।  
 
সরজমিনে গাংনীর বিভিন্ন মাঠ ও গ্রামে পরিদর্শন করে দেখা যায়, চাষিরা তামাকের পরিচর্যায়, তামাক সংগ্রহ ও পোড়ানোতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। পুরুষদের পাশাপাশি নারী-শিশুরাও এসব কাজে জড়িয়ে পড়েছে।  
 
তামাক পোড়ানোর জন্য জেলার বিভিন্ন স্থানে সহস্রাধিক চুল্লি বানানো হয়েছে। আর এসব চুল্লিতে ব্যবহার করা হচ্ছে হাজার হাজার টন জ্বালানি কাঠ। তামাক পোড়ানোর ফলে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে।  
 
ব্রিটিশ আমেরিকান ট্যোবাকো কোম্পানির মেহেরপুর লিফ ডিপোর ম্যানেজার সাজ্জাদ হোসেন বাংলানিউজকে জানান, জেলায় প্রায় তিন হাজার চুক্তিবদ্ধ তামাক চাষি রয়েছেন। কোম্পানি চুক্তিবদ্ধ এসব চাষিদের কাছ থেকে তাদের উৎপাদিত তামাক ক্রয় করবে। এছাড়া, আর কোনো তথ্য দেওয়া সম্ভব নয় বলে জানান তিনি।
 
তামাকের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে মেহেরপুর সিভিল সার্জন আব্দুল হালিম বাংলানিউজকে জানান, তামাকের উচ্ছিষ্ট অংশ শরীরে ঢুকে ক্যান্সার, হৃদরোগসহ নানা ধরনের মরণব্যাধি হতে পারে। যারা তামাক চাষের সঙ্গে জড়িত বিশেষ করে তামাক শ্রমিকরা এক সময় হৃদরোগ ক্যান্সারসহ জটিল রোগে আক্রান্ত হবেন। রোগ তাদের বাঁচানো সম্ভব হবে না।
 
এজন্য তামাক চাষ বন্ধ করে বিকল্প ফসলের আবাদ করার ও তামাক চাষের ক্ষতি তুলে ধরে সরকারিভাবে সভা-সমাবেশ-সেমিনার করা জরুরি বলে মনে করেন তিনি। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসন ও কৃষি বিভাগকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে বলেও জানান তিনি।
 
ক্ষতিকর দিক জানা সত্বেও বিভিন্ন তামাক কোম্পানির লোভনীয় প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে জেলার চাষিরা বছরের পর বছর তামাক চাষ অব্যাহত রেখেছেন। তামাক চাষ বন্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি, আইন প্রয়োগসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন জেলার সচেতন মানুষ।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৫৫৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৬      
এমজেড

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।