ঢাকা: রাজধানীর আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের গেটে তথ্য কেন্দ্র। ফরম হাতে দাঁড়িয়ে আছেন আব্দুল বাসিত।
কথা শোনে এগিয়ে যান বাসিতও। উল্টো তার প্রশ্ন, ‘কেমন হেল্প করতে পারবেন আপনি? আর কত টাকাই বা লাগবে?’
প্রথমবারের মতো পাসর্পোট করাতে এসেছেন আব্দুল বাসিত। তাই কিছুই বুঝতে পারছেন না তিনি। অনেকটা নিরুপায় হয়েই পাসপোর্ট অফিসের সামনে ঘোরাঘুরি করা আরেকজন মো. হাসানের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। ।
চল্লিশোর্ধ্ব ওইলোকের মতো হাসানও পাসপোর্ট অফিসের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী নন। এরপরও পাসপোর্ট প্রার্থীদের ‘সহযোগিতা’ করেন তিনি।
কিছুক্ষণ দর কষাকষির পর সাড়ে ১২ হাজার টাকার বিনিময়ে বাসিতের পাসপোর্টের পুরো দায়িত্ব নিলেন হাসান। নিজ পাসপোর্ট তৈরির দায়িত্ব অন্যকে দিয়ে বাসিতও বেশ হালকা!
রোববার (১৪ নভেম্বর) রাজধানীর আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে দালালদের এমন নানা চিত্র-ই দেখা গেলো। সরেজমিনে দেখা যায়, পাসপোর্ট অফিসের সামনে হাসানের মতো আরও অনেকে ঘোরাঘুরি করছেন। তথ্য কেন্দ্র থেকে ফরম নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হাজির তারা।
তাদের কাছে সিলসহ সবই আছে জানিয়ে যে যার মতো করে ক্লায়েন্ট (পাসপোর্ট প্রত্যাশী) ধরছেন। ‘লাইনে দাঁড়াতে হবে না’সহ শিগগির পাসপোর্ট পাওয়ার কথা বলে সহজেই লোকজনকে বাগিয়ে নিচ্ছেন দালালরা।
পাসপোর্ট প্রত্যাশীরাও কোনো হয়রানি ছাড়া পাসপোর্ট পেতে দ্বারস্থ হচ্ছেন দালালদের। তারাও বেশ দাপটেই অফিসের কতিপয় কর্মকর্তার যোগসাজশে চালিয়ে যাচ্ছেন এ কাজ। বাংলানিউজকে হাসান বলেন, ‘প্রথমবারের মতো জরুরি পাসপোর্ট ৮দিনের মধ্যে দেওয়া হয়। এজন্যে চ্যানেল ম্যানেজ, ব্যাংকে জমার ৬ হাজার ৯০০ টাকাসহ সাড়ে ১২ হাজার টাকা দিতে হবে। ’
‘শুধু ফরম পূরণ ১০০ টাকা, ফরম পূরণ, সত্যায়িত ও সিল নিতে খরচ সাড়ে ৬৫০টাকা। পাসপোর্ট রিনিউ করতেও ব্যাংক জমা ও জরিমানাসহ একই পরিমাণ টাকা লাগবে। একমাসের মধ্যে পাসপোর্ট নিলে ব্যাংক জমার টাকা ছাড়া বাড়তি ২ হাজার টাকা আমাদের দিতে হবে। ’
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘কী মনে করেন? এই টাকা শুধু আমরাই খাই! অফিসের নিচে আনসার, পুলিশ থেকে শুরু করে উপরমহলের সবাই রে দিতে হয়। গত আট বছর ধরেই এভাবে কাজ করছি। ’
‘তাদের সঙ্গে সিস্টেম না করলে, এখানে কাজ করা যায় না। পুলিশ তো আছে-মাসে তাদের জনপ্রতি ৬০০ টাকা দিতে হয়। মাঝে মাঝে ধরলে দিতে হয় ৫০/১০০ টাকা,’ যোগ করেন তিনি।
অবস্থান করে দেখা যায়, দালালদের পাঠানো লোকজনের ফরম দেখেই ভেতরে প্রবেশ করতে দিচ্ছেন আনসার সদস্যরা। আর ভেতরের কর্মকর্তারাও তা দেখলেই বুঝে যান বিষয়টি।
আবদুল মান্নান নামে আরেক দালাল বলেন, ‘আমরা সৎ উপায়ে ইনকাম করি, উপরের কর্মকর্তারাই আমাদের সেট করছে। একটা পাসপোর্ট করতে যে টাকা নেই, তার ১০ শতাংশ আমাদের পকেটে ভরি। বাকি ৯০ শতাংশ যায় পুলিশ, আনসার ও কর্মকর্তাদের পকেটে। ’
বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে ছেলের পাসপোর্ট করাতে এসেছেন ফয়েজ খান। নিজের পাসপোর্ট করার তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে ছেলেরটা দালালদের দিয়েই করাচ্ছেন তিনি। বললেন, ‘এখানে সুস্থভাবে কাজ করার কোনো উপায় নেই। তাই আগেই ছেলেকে বলেছি মানুষ ধরে কাজ করতে। একজনকে সাড়ে ১২ হাজার টাকা দিয়েছে, সে-ই সব করে দিচ্ছে। ’
‘তারা ফরমে একটা চিহ্ন দেয়, আর সেটা নিয়ে ভেতরে গেলে দ্রুত জমা নেওয়া হয়। আর ৮ দিনের মধ্যে পাসপোর্ট দিয়ে দিবে,’ জানান ফয়েজ খান।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থেকে আগারগাঁও পাসপোর্ট করাতে এসেছেন সীমা আক্তার। বললেন, ‘নিজের হাতে ফরম পূরণ করে সত্যায়িত করিয়ে জমা দিতে গেছি, কর্মকর্তারা বলেন-সেখানে ভুল আছে। পরে আবার দালালদের দিয়ে নতুন ফরম পূরণ করে জমা দিয়েছি। এ জন্য দালালকে সাড়ে ৬০০ টাকা দিতে হয়েছে। ’
সীমার অভিযোগ, ‘দালালদের দৌরাত্মের কারণে পদে পদে হয়রানিতে পড়তে হয়। অনেকেই নিজ উদ্যোগে পাসপোর্ট জমা দিতে আসেন। কিন্তু অফিসে এসে বাধ্য হন দালালদের দিয়ে করাতে। ’
তবে এ বিষয়ে কথা বলতে বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের পরিচালক এটিএম আবু আসাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তিনি মোবাইল ফোন রিসিভ করেননি।
বাংলাদেশ সময়: ০৮০৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০১৬
এমসি/এমএ