কমলগঞ্জ (মৌলভীবাজার) থেকে ফিরে: সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে, ডোবার প্রায় আধঘণ্টা বাকি। ছোট-ছোট মণিপুরী শিশুদের নৃত্যশৈলীতে মুগ্ধ দর্শনার্থীরা।
গত ১৪ নভেম্বর বিকেলে রাসলীলা প্রাঙ্গণে শত-শত মানুষের ভিড়। দূরে থেকে মাইকে ভেসে আসছে নৃত্য সংগীতের সুর। মণিপুরী রাসলীলাকে কেন্দ্র করে দলে-দলে মানুষ জড়ো হচ্ছিলেন সেখানে। উপচে পড়া মানুষের ভিড়ে উৎবসমুখর এলাকার আশপাশ বিক্রি-বাট্রাও বেশ জমেছিলো।
অনুষ্ঠান স্থলে দেখা যায়, সাদা কাগজ দিয়ে কারুকার্যে ভরা নকশায় সাজানো হয়েছে এক মণ্ডপ। দূর-দূরান্ত থেকে জড়ো হওয়া মণিপুরী নৃত্য শিল্পীদের সুনিপুণ নৃত্যগীতি মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছে আগত সব দর্শনার্থীদের। মণিপুরী সাংস্কৃতিক পরিষদের উদ্যোগে শ্রীকৃষ্ণের ৩১তম মহারাস এই উৎসব। সার্বিক তত্ত্বাবধানে রয়েছেন ১০৬ বছর বয়েসী লৈবাক ফালু। গম্ভীর প্রকৃতির লোকটি প্রায় অর্ধশত বছর ধরে মণিপুরী নৃত্যকলার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। নৃত্যের মধ্যে তিনি ছোটখাটো ভুল ভ্রান্তি শিশুদের ধরিয়ে দিচ্ছিলেন।
দুপুর ১টা থেকে শুরু হয়েছে এই গোষ্ঠলীলা রাখাল নাচ। স্থানীয় ভাষায় এ নাচকে ‘রাখুয়াল’ বলা হয়। সেই নাচ চলে গোধূলি লগ্ন পর্যন্ত। তারপর রাত ১১টা থেকে পরদিন ভোর পর্যন্ত চলে শ্রীকৃষ্ণের মহারাসলীলা। প্রবীণ লৈবাক ফালু ‘রাখুয়াল’ নাচ প্রসঙ্গে বলেন, ‘শ্রীকৃষ্ণ, সখা বলরাম ও অন্যান্য রাখাল বালক গরু চরাতে গিয়ে সম্মুখীন নানা ঘটনার চিত্র এ রাসে রূপায়িত হয়। মণিপুরী শাস্ত্রীয় নৃত্যের বৈষ্ণব ভক্তিভাবাপন্ন নরম কোমলভাবের বিপরীতে এখানে তাণ্ডব ধারার নৃত্যই প্রধান।
শ্রীকৃষ্ণের মহারাসলীলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গুরু বসেন মৃদঙ্গ নিয়ে। আর যশোদা ও রোহিনী-রূপী নারীদ্বয় মণ্ডপের এক কোণে বসে গান ও অভিনয় কর্ম সম্পন্ন করেন। বৈষ্ণব সাহিত্যের রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলার এক নৃত্যগীতাভিনয় অনুষ্ঠান হচ্ছে রাসলীলা। আদমপুরের মণিপুরীদের রয়েছে দু’টি বিষ্ণুপ্রিয়া ও মৈতৈ সম্প্রদায়।
সম্প্রদায় দুটির মধ্যে বছরের পর বছর ধরে রাসলীলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর জোড়া মণ্ডপে বিষ্ণুপ্রিয়া সম্প্রদায়ের এ বছর মহারাসলীলার ১৭৪তম বর্ষপূর্তি উৎযাপিত হয়েছে। আর আদমপুরের নয়াপত্তন গ্রামের অমুথোই শর্ম্মার মণ্ডপে চলেছে মৈতৈ সম্প্রদায়ের মহারাসলীলা উৎসব।
মণিপুরী সাস্কৃতিক পরিষদের সভাপতি চন্দ্রকীর্তি সিংহ বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের মণিপুরী নৃত্যের রয়েছে গৌরবময় পটভূমি। নিজস্ব কৃষ্টি ও সংস্কৃতির ধ্রুপদীধারা মণিপুরীদের একটি বিশেষ স্থান করে দিয়েছে।
তিনি বলেন, ১৯১৯ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সিলেট ভ্রমণে এলে মণিপুরী মেয়েদের পরিবেশিত এই রাসনৃত্য দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কমলগঞ্জের নৃত্য শিক্ষক গুরু নীলেশ্বর মুখার্জীকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে মণিপুরী নৃত্যবিভাগের প্রবর্তন করেছিলেন।
মণিপুরী সম্প্রদায়ের বিশেষ এ নৃত্য দেখতে আদমপুর পরিণত হয় হাজার-হাজার মানুষের মিলন মেলায়। সেই নৃত্য-গীতের অপূর্ব মূর্ছনায় ভরে উঠে মণ্ডপ প্রাঙ্গণ। মাথার ওপরে দাঁড়িয়ে পূর্ণিমার বড় চাঁদ। পূর্ণিমাতিথি থেকে পহেলা অগ্রাহায়ণ, সেদিনের চাঁদটি অপেক্ষাকৃত বড়ই ছিলো। হেমন্তের সেই অনন্য রাতে মণিপুরী নৃত্যের সাথে ইশ্বর যেন প্রকৃতিতে অপরূপ এক জ্যোৎস্নার আলো ছড়িয়েছিলো।
বাংলাদেশ সময়: ১৪১৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৬, ২০১৬
বিবিবি/টিআই