কলকাতা থেকে ফিরে: বাবা আর ছেলের বাস কাছাকাছিই। আদরের বোনটিকেও দেখতে পারছেন ভাই।
এক জায়গা থেকে সীমান্তের ওপারে স্বজনদের বাড়িতে যেতে হলে লাগে পাসপোর্ট-ভিসা। যা গ্রামের অনেকেরই নেই। তাই বছরের পর বছর স্বজনদের মুখ চাওয়া-চাওয়ি না করেই কাটিয়ে দিচ্ছেন তারা।
ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী-বিএসএফ এর আমন্ত্রণে পশ্চিমবঙ্গ সফরকালে দুই দেশের সীমান্তের গ্রাম পরিদর্শন করেন বাংলাদেশি সংবাদকর্মীরা।
সীমান্তে এমন বাড়িও রয়েছে, যাদের ঘর বাংলাদেশে কিন্তু উঠান পড়েছে ভারতে। প্রতিদিন দূর থেকে দেখা হলেও ভাই কিংবা বোন না অথবা বাবার বাড়িতে আসতে পারছেন না কেউ। বাবার বাড়িতে নাইয়র আসার বাসনা থাকলেও সীমানা ভেদের সাধ্যে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না গ্রাম্য বধূরা। চোখের জল ফেলেই যান নীরবে।
সাতক্ষীরা জেলার ভোমরা সীমান্ত থেকে উত্তর-পশ্চিমে দু’দেশের সীমানা ঘেঁষা দু’টি গ্রাম। একটির নাম হাড়দ্দা, অন্যটি চর পানিতর।
আবহমান বাংলার অন্যান্য গ্রামের মতোই সবুজ শস্য-শ্যামল চর পানিতর ও হাড়দ্দা। মানুষের কথা-বার্তা জীবনাচারও প্রায় একই। কিন্তু এর মধ্যেও রয়েছে বড় পার্থক্য।
হাড়দ্দা বাংলাদেশের সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ভোমরা ইউনিয়নের একটি গ্রাম। আর চর পানিতরের অবস্থান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার বসিরহাট থানায়।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর থেকে এ গ্রাম দু’টি আলাদা হয়ে যায়। আলাদা হয়ে যায় গ্রামবাসীর সম্পর্কও!
গ্রাম দু’টির পশ্চিম পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ইছামতি নদী। এ নদীতে রয়েছে বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্ত রেখার এক নম্বর পিলার।
এ পিলারই বুঝিয়ে দিচ্ছে হাড়দ্দা গ্রামের মানুষ বাংলাদেশের আর চর পানিতর গ্রামের বাসিন্দারা ভারতের নাগরিক।
সরেজমিনে দেখা যায়, সীমানা পিলারটি এমন জায়গায় যে, কারও খাবার ঘর পড়েছে ভারতে তো শোবার ঘর বাংলাদেশে। ভারত সীমান্তের ভেতরের তাল গাছের গোড়া থাকলেও মাথা হেলে পড়েছে বাংলাদেশে।
নিত্য সকালে ঘুম থেকে জেগেই দেখা হচ্ছে একে-অন্যের সঙ্গে। কিন্তু পাসপোর্ট-ভিসা না থাকায় এপার-ওপার হতে পারছেন না কেউ-ই।
‘সীমানা রেখা’ নিয়ে কথা বলছিলেন ভারতের চর পানিতর গ্রামের রজব আলী মোল্লার (৬৭) সঙ্গে। বোন আমেনা বিবির বিয়ে হয়েছে বাংলাদেশের জয়নাল আবেদীন মোল্লার সঙ্গে। যা তার গ্রাম থেকে তিন কিলোমিটার দূরের হাড়দ্দাতে।
কিন্তু বিয়ের পর গত ত্রিশ বছর ধরে বোনকে একনজর দেখতে পারেননি তিনি। বেশ আক্ষেপ নিয়ে বলছিলেন, আজ থেকে ৩০ বছর আগে সীমান্তের ওপার-ওপার যাওয়া যেতো, তখনই বোনের বিয়ে হয়। কিন্তু পিলার দেওয়ার পর ভিসা ছাড়া এপার-ওপার হওয়া যায় না।
‘আমার বোন কেমন আছে, কীভাবে আছে কিছুই জানি না। বোনকে দেখতে খুব চায় মন। একটা টোকেন বা সংক্ষিপ্ত ভিসা থাকলে আত্মীয়ের বাড়ি যেতে পারি আমরা। ’
একই খেদ বাংলাদেশের নাগরিক জাকির আলী গাজীর মনেও। তার ভাষায়, আমাদের মধ্যে কোনো ঝামেলা হয় না। তবে চাইলেও ভারতে আত্মীয়ের বাড়ি যেতে পারি না। ভিসা না থাকায় খুব কাছাকাছি থেকেও আপনজনদের সঙ্গে দেখা করতে পারি না।
এ বিষয়ে বিএসএফ-এর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিক্রম শর্মা বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমরাও চাই একটি টোকেন সিস্টেম চালু হোক। যেন সারাদিন কাজ করে আবার বাসায় ফিরতে পারে মানুষজন। ’
‘একদিনের ভিসা ব্যবস্থা চালু হলেও এখানে সবাই আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি আসা যাওয়া করতে পারবে। ’
বিএসএফ-এর আমন্ত্রণে ইন্দো-বাংলা বর্ডার পরিদর্শন করেন বাংলাদেশের সংবাদকর্মীরা। তিনদিনের এ সফরে বিএসএফ সদস্যরা ভারতের সীমান্তের বিভিন্ন স্পট ঘুরে দেখান। ১৬ নভেম্বর দেশে ফিরে প্রতিনিধিদলটি।
বাংলাদেশ সময়: ১১২০ ঘণ্টা, নভেম্বর ২১, ২০১৬
এসএম/এমএ