ঢাকা: জঙ্গিপনার অনেক কিছুরই ডিসকভারি হয়েছে শোলাকিয়া হামলা পরবর্তী তদন্ত আর জিজ্ঞাসাবাদে। নব্য জেএমবির ক্লু এখান থেকেই মিলেছে।
কথাগুলো বাংলানিউজকে বলছিলেন কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানার ওসি (তদন্ত) মোর্শেদ জামান। মোর্শেদকে কারও ভোলার কথা নয়। নিজের অসীম সাহসিকতায় তিনি গত ঈদ-উল-ফিতরের দিনে শোলাকিয়ার ঈদগাহ সংলগ্ন এলাকায় একটি জঙ্গি হামলা রুখে দিয়েছিলেন। নিজের জীবন বাজি রেখে সেদিন বড় ধরনের নাশকতা রোধ করতে পেরেছিলেন তিনি।
শোলাকিয়ার সবুজবাগ মোড় পুলিশ চেকপোস্টে সেদিন বোমা ও চাপাতি নিয়ে জঙ্গিরা যে অতর্কিত হামলা চালিয়েছিলো তাতে নিহত হন দুই পুলিশ সদস্য জহিরুল ও আনসারুল।
ঢাকা থেকে নেওয়া টেলিফোন সাক্ষাৎকারে মোর্শেদ জামান বাংলানিউজকে বলেন, সহকর্মীর মৃত্যু আর একই সঙ্গে ঈদের জামাতে লাখো মানুষকে রক্ষা করার প্রত্যয় সেদিন নিজের বিপদ, নিজের জীবনের ঝুঁকি ভুলিয়ে দিয়েছিলো। আর সে কারণেই পেরেছিলাম প্রতিরোধ গড়ে তুলতে। সেদিন সেই অভিযানে তার সঙ্গে ছিলেন আরও তিন পুলিশ কনস্টেবল। পরের দিকে যোগ দেন আরও কয়েকজন।
তিনি বলেন, সেদিন যে গলির ভেতর থেকে জঙ্গিরা আমাদের সঙ্গে গুলিবিনিময় করছিলো সেটি দিয়ে চলে যাওয়া যেতো শোলাকিয়ার ময়দানে। আমরা যদি এদিকে জঙ্গিদের ব্যস্ত করে না রাখতাম, তারা অনায়াসেই চলে যেতে পারতো সেই ময়দানে। তাতে কত বড় ক্ষতি হতে পারতো তা যে কেউই আঁচ করতে পারে। সেদিনের সে ঘটনা ছিলো অনেকটা যুদ্ধে অংশগ্রহণ, আমরা তা করেছি। দেশের স্বার্থেই করেছি, সাধারণের প্রাণরক্ষার স্বার্থেই সেই সকালে পুলিশ প্রতিরোধ গড়ে তুলে শহীদ হয়।
মোর্শেদ বলেন, সেদিনের কথা মনে করলে আজও শিউরে উঠি। অনেকেই বলেছেন, আমাদের বেশি ঝুঁকি নেওয়া হয়েছে। যে কোনো মুহূর্তে বিপদ হতে পারতো। আমারও মনে হচ্ছিলো ওদের হাতে গ্রেনেড থাকলেই বিপদ। যে পিস্তলের গুলি তারা ছুড়ছিলো তা আমার হাতের চায়না রাইফেলের কাছে কিছুই না। কিন্তু গ্রেনেড হলে তা চার্জ করলে মারা পড়বো সে শঙ্কা ছিলো, কিন্তু থামিনি।
গ্রেনেড চার্জ জঙ্গিরা ঠিকই করেছিলো, কিন্তু তা সৌভাগ্যক্রমে ড্রেনে পড়ে বিস্ফোরিত হয়, ফলে আমরা স্প্লিন্টার থেকে রক্ষা পেয়ে যাই। মহান আল্লাহরও রহমত আমাদের সঙ্গে ছিলো সেদিন, বলেন মোর্শেদ।
সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া যে স্বল্পক্ষণের ভিডিওচিত্রে মোর্শেদ জামানকে জিন্স ও নীল পাঞ্জাবি পরে দেয়ালের আড়াল থেকে গুলি করতে দেখা যায় তা ছিলো পুরো দুই ঘণ্টার অভিযানের মাঝামাঝি কোনো এক সময়ের। এই লড়াইয়ে তিনি এর চেয়েও ঝুঁকি নিয়েছিলেন। আর শেষ পর্যন্ত জঙ্গিদের বিশ গজের মধ্যে পৌঁছে গিয়ে এক পর্যায়ে তাদের কব্জা করে ফেলেন।
মোর্শেদ বলেন, জঙ্গি শফিউলকে সেদিন জীবিত ধরে ফেলতে পারা ছিলো একটি বড় সাফল্য। তা কেবল সেই দিনের অভিযানের জন্যই নয়, জঙ্গিদের আগে পরের অনেক তথ্যই পরে জানা গেছে শফিউলকে জিজ্ঞাসাবাদে। যার ভিত্তিতেই একে একে বাংলাদেশে জঙ্গিদের প্রধান প্রধান মাথাগুলোকে আরও অস্তিত্বহীন করে তোলা সম্ভব হয়েছে।
এতে পরিকল্পনাকারীরা যেমন ধরা পড়েছে, প্রশিক্ষকরাও ধরা পড়েছে, আর জঙ্গিদেরও চিহ্নিত করে হত্যা করা সম্ভব হয়েছে। মদতদাতারা ধরা না পড়লেও তাদের তথ্য মিলেছে।
শোলাকিয়া হামলার আগে জঙ্গিদের প্রধানরা সেখানে গিয়ে কীভাবে কি করেছিলেন তাও আমরা জেনেছি, আর সে অনুযায়ী অভিযান চালিয়েছি, বলেন মোর্শেদ।
তিনি বলেন, শোলাকিয়া হামলার পর আমরা এখানে প্রতিটি বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে তল্লাশি-তদন্ত করেছি। এ ধরনের জঙ্গিদের যাতে কেউ আশ্রয়-প্রশ্রয় না দেয়, কেউ যাতে ভুল করে তাদের বাড়িভাড়া না দেয় এগুলো নিয়ে তাদের উদ্বুদ্ধ করেছি। ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে উঠোন বৈঠক করে আমরা জঙ্গিবিরোধী সচেতনতা সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছি।
জঙ্গিদের এখনো পুরোপুরি নির্মূল করা যায়নি। নব্য জেএমবির যে উত্থান হয়েছে তাতে এই পুরনো জঙ্গিরা স্থান করে নিচ্ছে সে খবর পুরোপুরি গোয়েন্দা পুলিশের কাছে রয়েছে। এরা কোথায় কি করছে তার ওপরও নজরদারি রয়েছে। মডারেটেড জঙ্গিরা এখন কেউ ডাকাতদলের সদস্য, কেউ অস্ত্র সাপ্লায়ার, কেউ হুন্ডি ব্যবসায়ী সেজে নতুন নতুন ফন্দি আঁটছে। তাও আমাদের জানা।
বাংলাদেশ পুলিশ, গোয়েন্দা বাহিনী, কাউন্টার টেরোরিজমের সদস্যরা সদা সজাগ রয়েছে। সারাক্ষণ আমরা চোখ-কান খোলা রাখছি। আশা করি জঙ্গিরা দেশে আর মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না, বলেন মোর্শেদ জামান।
বাংলাদেশ সময়: ০১৩০ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪, ২০১৬
এমএমকে/এএ