আশুলিয়া, সাভার: অন্য সবার মত রেহেনারও ছিল স্বামী সন্তান ও বোন-দুলাভাইসহ পরিপূর্ণ একটি সংসার। কিন্তু একরাতের মধ্যেই পাল্টে যায় তার জীবনের গল্প।
২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর আশুলিয়ার নিশ্চিতপুরে পোশাক কারখানা তাজরীনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় রেহেনা হারায় তার পরিবারের চার সদস্যকে।
এ দুর্ঘটনার পর থেকে তিনি আর কাজে যোগদান করতে পারেন নি। কারখানায় আগুন লাগার পর বাঁচার জন্য চারতলা থেকে লাফিয়ে পড়েছিলেন তিনি। এ কারণে তার দুই হাতে জানালার কাঁচ ঢুকে যায়। চিকিৎসা শেষ হলেও দুই হাতে এখন আর তেমন শক্তি পান না।
ফলে সংসারের হাল ধরতে জেএসসিতে জিপিএ ৫ প্রাপ্ত মেধাবী সন্তানরা পড়ালেখা ছেড়ে নাম লেখিয়েছে পোশাক শ্রমিকের তালিকায়।
আশুলিয়ার নিশ্চিতপুরের দুঃস্বপ্নের সাক্ষী তাজরীন ফ্যাশনের ভবনের সামনে খোঁজ মিললো রেহেনার। হাজারো আর্তনাদের স্মৃতি নিয়ে প্রায়ই দাঁড়িয়ে থাকেন পুড়ে যাওয়া কারখানাটির সামনে। খুঁজে ফেরেন সেই সব দিনগুলো। এখানে জীবনের সব আনন্দ হারিয়েছেন তিনি। শেষ কবে তিনি হেসেছিলেন তা তার নিজেরও জানা নেই। এখনও হাতের ব্যথায় মুর্ছা যান বার বার। চোখের সামনে পরিবারের চার সদস্যের মৃত্যু কি কোনদিন ভুলতে পারবেন তিনি? হয়তো পারবেন না।
২০১০ সালের জুন মাসে তাজরীনে যোগদান করেন রেহেনা। তারপর থেকে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ভালই দিন কাটছিল। স্বপ্ন দেখতেন ছেলে মেয়েগুলোকে বড় ডাক্তার, উকিল বানাবেন। কিন্তু ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর হঠাৎ আগুনে পুড়ে যায় রেহেনার ভাগ্য। থমকে যায় জীবন চলার গতি। জমি বিক্রি, ঋণ করে চালানো হয় চিকিৎসা। তবে বিভিন্ন সংস্থা থেকে আড়াই লাখ টাকা পাওয়ায় কোন রকম ঋণ পরিশোধ ও চিকিৎসা করে বেঁচে আছেন। কিন্তু জীবন থেকে যা হারিয়েছে তা কি পূরণ করা সম্ভব?
আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশনের অগ্নিকাণ্ডের চার বছর পর ভবনটির সংস্কার কাজ শুরু হলেও শেষ হয়নি নিহত পরিবারে আহাজারি ও আহত শ্রমিকদের চিকিৎসা সেবার আকুতি। বিদেশি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সহযোগিতায় কিছুটা স্বস্তি পেলেও আতঙ্ক কাটেনি শারীরিকভাবে অক্ষম রেহেনার। জীবন কাটছে দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে যা কখনও ভুলবার নয়।
২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর তাজরীন ফ্যাশনের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সময় ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে অগ্নিদগ্ধ রেহেনা বেঁচে গেলেও হারায় বড় বোন আমেনা, দুলাভাই নজরুল ও তার ছেলে নয়ন ও ছেলের বউ মনিরা বেগমকে। রেহেনা বেঁচে থেকেও এখন যেন মৃত। কোন কাজ করার ক্ষমতা নেই, ভ্যান চালক স্বামী সুলতান এবং দুই ছেলেমেয়ের আয়ে কষ্ট করে চলছে তার সংসার।
আলাপকালে রেহেনা বলেন, চোখের সামনে সহকর্মী এবং নিজের পরিবারের চার সদস্যকে আগুনে পুড়ে ছটফট করে মরতে দেখেছি। জীবন বাঁচাতে জানালা ভেঙে চারতলা থেকে লাফিয়ে পড়েছি। পরবর্তীতে নিজেকে খুঁজে পেয়েছি হাসপাতালের বিছানায়। সেসময় মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে যায় আমার, কাঁচ ঢুকে যায় দুই হাতে।
এক বছর চিকিৎসার পর কিছুটা সুস্থ হলেও আজীবনের জন্য হাত দু’টির শক্তি হারিয়ে ফেলি। মাঝে মাঝে অচল হয়ে থাকে শরীরের বিভিন্ন অংশ।
নিজে কাজ করতে না পারায় মেধাবী ছেলে-মেয়ে সাগর ও সুমিকে সংসারের হাল ধরতে হয়েছে। ছেলে-মেয়েরা যেন লেখাপড়া করতে পারে সেজন্য তিনি পুনর্বাসনের ব্যবস্থা ও আর্থিক সহায়তাসহ কোন কাজের ব্যবস্থা করে দেওয়ার দাবি জানান।
বাংলাদেশ সময়: ১৩২৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪, ২০১৬
আরএ