ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

ভালো নেই নেত্রকোনার যাত্রাশিল্পীরা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২৪৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪, ২০১৬
ভালো নেই নেত্রকোনার যাত্রাশিল্পীরা ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

যুগের সাথে তাল মিলিয়ে সবকিছু এগিয়ে গেলেও এগুতে পারেনি গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী যাত্রাশিল্প! পরিবর্তনের ধারায় আধুনিকতাতে পিছিয়ে পড়া নেত্রকোনার যাত্রাশিল্পীরা মোটেও ভালো নেই এখন । ব্যবসার মৌসুম চললেও আয়োজকদের ডাক-সাড়া না পাওয়ায় বেকারত্বে অস্তিত্ব-সংকটে শিল্পীরা কঠিন সময় পার করছেন। মঞ্চে ওঠে অভিনয় করে দর্শকদের যারা মাতিয়ে তুলতেন তারাই আজ বাস্তবতার কষাঘাতে দিকভ্রান্ত!

নেত্রকোনা : যুগের সাথে তাল মিলিয়ে সবকিছু এগিয়ে গেলেও এগুতে পারেনি গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী যাত্রাশিল্প! পরিবর্তনের ধারায় আধুনিকতাতে পিছিয়ে পড়া নেত্রকোনার যাত্রাশিল্পীরা মোটেও ভালো নেই এখন । ব্যবসার মৌসুম চললেও আয়োজকদের ডাক-সাড়া না পাওয়ায় বেকারত্বে অস্তিত্ব-সংকটে শিল্পীরা কঠিন সময় পার করছেন।

মঞ্চে ওঠে অভিনয় করে দর্শকদের যারা মাতিয়ে তুলতেন তারাই আজ বাস্তবতার কষাঘাতে দিকভ্রান্ত!

নেত্রকোনার যাত্রাদল ‘তিতাস নাট্যসংস্থা’র বিবেক শংকর চন্দ্র সরকার। তিনি যাত্রাদলে কাজ করেন ৩৫ বছর ধরে। বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘বড় দুঃসময় পার করছি। ব্যবসার মৌসুম চলছে; অথচ কোথাও থেকে মঞ্চের জন্যে একটি ডাক আসেনি’।

‘এভাবে বেকারত্বে দিন কাটলে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বাঁচবো কী করে’  এই আক্ষেপ রেখে শংকর বলেন, ‘নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। কিন্তু আমাদের আয়-রোজগার তো বাড়েনি। বরং যাত্রা মঞ্চায়ন অজানা কারণে বন্ধ হয়ে আছে’। মঞ্চকাঁপানো একসময়কার তুখোর যাত্রা-নায়িকা সুরভী সাহা। এখন তার বয়স প্রায়
পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই। তিনি নিজেই ‘সুরভী অপেরা’ দলের পরিচালক। সুযোগ হলে ডাক পেলে মঞ্চে ওঠেন। তবে আজ আর নায়িকা নন তিনি। মমতাময়ী মা’র ভূমিকায় কাজ করেন। অর্থাৎ যাত্রাদলে চরিত্র পরিচিতিতে যাকে বলা হয় ‘মাদার’।

 বর্তমান সময়ে যাত্রাপালা ও সংশ্লিষ্টদের দুর্দিন নিয়ে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল, স্মার্ট মোবাইল ও ইন্টারনেট সংযোগের কাছে সেকেলে আমরা বড্ড অসহায়। প্রযুক্তির ব্যবহারে দুনিয়া এগিয়েছে বটে, তবে প্রযুক্তি কোনোকোনো ক্ষেত্রে গ্রামীণ ঐতিহ্য-সংস্কৃতির এই পেশাকে ক্ষতিগ্রস্তও করেছে। ’

‘বর্তমান সময়ে মানুষ স্মার্টফোন ব্যবহার করে ১০ টাকা বা ৫ টাকার ইন্টারনেট খরচ করে বিশ্বের সব বিনোদন পেয়ে যায়’—এই  দাবি করে সুরভী আরও বলেন, ‘ভারতীয় চ্যানেলগুলো শুধু আমাদের যাত্রাকে নয়, রীতিমতো সমাজ ও দেশ ধ্বংস করে দিয়েছে। এসব কারণে মানুষের কাছে যাত্রাপালার প্রয়োজনীয়তা আরও ফুরিয়ে যাচ্ছে। তারপরও কোনোকোনো জায়গায় চাহিদা থাকলে কালেভদ্রে আয়োজক পার্টি আমাদের কাছে আসেন। কিন্তু জীবন সংসার বা পেট (ক্ষুধা) তো তা মানে না!’

যাত্রাশিল্পী বা যাত্রাদলের করুণ অবস্থা সম্পর্কে কথা হয় ‘রূপা অপেরা’র পরিচালক নায়িকা রূপা আক্তার’র সাথে। কথা প্রসঙ্গে রূপা বাংলানিউজকে বলেন, ‘একসময় আয়োজকদের কাছ থেকে ১০-১৫ হাজার টাকা কন্ট্রাক্ট নিয়ে একটি মঞ্চ করতে পারতাম। সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় আজ আর তা সম্ভব হয় না। বর্তমান বাজারে টেনেটুনে হলেও একটি মঞ্চ করতে ৪০-৪৫ হাজার টাকা লাগে। প্রতিটি যাত্রাদলে কম করে হলেও ৫০ জন সদস্য থাকে। ’ নেত্রকোনা শহরের সাতপাই রেলক্রসিং এলাকায় ১০ টি যাত্রাদলের ৫০০ কলাকুশলী শিল্পী রয়েছেন বলে  বাংলানিউজকে জানান ‘বিউটি অপেরা’র স্বত্বাধিকারী আবু সাঈদ তালুকদার।

বেকার শিল্পীরা আজ অভাব অনটনে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। পুরুষরা কেউ পেশা বদল করে রিকশা বা অটোরিকশা চালিয়ে জীবন চালান। এভাবে চলতে থাকায় গ্রামীণ এ শিল্প বিলুপ্তির পথে দাঁড়িয়েছে বলে মত দেন সাঈদ।

তিনি জানান, এতসব টানাপোড়নের পরও কোনো আয়োজক এলেও শেষ পর্যন্ত প্রশাসনের অনুমিত না পেয়ে মঞ্চায়ন করা সম্ভব হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রশাসন আয়োজকের যাত্রা মঞ্চায়নের আবেদন নাকচ করে দেন!

তবে আবু সাঈদ তালুকদারের দাবির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক (ডিসি) ড. মুশফিকুর রহমান। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ‘যাত্রার পারমিশন চাওয়ার পর কেউ পারমিশন পাননি এমনটি আমার জানা নেই। এ পর্যন্ত যারা যাত্রার পারমিশন চেয়ে আমার কাছে এসেছেন তাদের প্রত্যেককে আমি যাত্রা মঞ্চায়নের পারমিশন দিয়েছি। ’

এরপর কথা হয় নেত্রকোনা সরকারী কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কবি সরোজ মোস্তাফা’র সঙ্গে। বিলুপ্তির পথে যাত্রাপালা এ বিষয় নিয়ে তার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে নিজ শৈশবের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘পরিবারে সব সদস্য মিলে একসময় গ্রামে রাত জেগে যাত্রা দেখতাম। শীতের রাত ঠাণ্ডায় শরীর জমে আসার পরও যাত্রা শেষ না করে উঠতাম না। চাদর কিংবা কাঁথা মুড়ি দিয়ে বসে থাকতাম। বর্তমান সময়ে বেড়েছে মানুষের বিনোদনের মাধ্যম। অথচ কোনটা সুস্থ আর কোনটা অসুস্থ ধারার বিনোদন এটা সাধারণ দৃষ্টিতে বুঝে ওঠা কষ্টসাধ্য। যে যাত্রাপালা আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশ, আজ আর কোথাও তার চর্চা দেখি না। বর্তমান প্রজন্মের অনেক ছেলেমেয়ে জানেই না যাত্রা কি! বিষয়টি নিঃসন্দেহে কষ্টের ব্যাপার। ’

বাঙালির সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে যাত্রাশিল্পকে পুনর্জীবিত করা প্রয়োজন বলে মনে করেন ওই অধ্যাপক। তিনি বলেন, ‘এ মাটি ও মানুষের কথা বলে যাত্রাশিল্প। ’

বাংলাদেশ সময়: ০৪৩৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৫, ২০১৬
জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।