ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

অনন্যা বণিকের অনন্য সংগ্রামের গল্প

রীনা আকতার তুলি, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৪২ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৫, ২০১৬
অনন্যা বণিকের অনন্য সংগ্রামের গল্প

আগের গল্পগুলো অনেক বিব্রত হওয়ার। সময়ের সঙ্গে সংগ্রাম করে এখন বেশ স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় তিনি। নাম তার অনন্যা বণিক। সমাজের চোখে অনন্যা ‘হিজড়া’। 

ঢাকা: আগের গল্পগুলো অনেক বিব্রত হওয়ার। সময়ের সঙ্গে সংগ্রাম করে এখন বেশ স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় তিনি।

নাম তার অনন্যা বণিক। সমাজের চোখে অনন্যা ‘হিজড়া’।  

অনন্যার বয়স তখনও ১৪ বছর হয়নি, সেসময় ভর্তি হন বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে, নাচ শেখার জন্য। এখন নিজেই নাচ শেখান শিশুদের। ‘স্বত্ত্বা’ নামে একটি নাচের স্কুল গড়ে তুলেছেন। তার সঙ্গে আছেন সমাজে উপেক্ষিত কাজল, সোনিয়া, শুকতারা, সুমি, এনিসহ ১২ জন।

পুরান ঢাকার ওয়াইজঘাটে তাদের নাচের স্কুলটি। সেখানেই অনন্যার সঙ্গে কথা হচ্ছিল বাংলানিউজের।

অনন্যা বলেন, “আল্লাহ বানাইছে, চেহারা ভাইয়ের মতোও না, বোনের মতোও না, লোকে কাজও দিতে চায় না। সংসারে রাখতে চায় না বাপ-মা। বেঁচে থাকাই কষ্টের। ”

হিজড়াদের উচ্ছৃঙ্খলতা নিয়ে যে অভিযোগ আছে সেটি খণ্ডন করেন তিনি। বলেন, “সবাই ডানপিঠে আর অবাধ্য হয় না। অনেকে সেবাপরায়ণও হয়। ”

অনন্যা পরিবারচ্যুত হওয়ার দুঃখের গল্প বলেন, “লেখাপড়ার চলাকালেই বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে নাচ শিখছিলাম। ১৪ বছর বয়সেই শারীরিক পরিবর্তন বুঝতে পারি। মাকে জানাই। মাও বুঝতে পারেন আমি হিজড়া। পরিবারে জানাজানি হয়। তখনও মা-বাবা ভালো ব্যবহার করলেও অন্য ভাই-বোনেরা আমার সঙ্গে মিশতে চাইছিলো না। একসঙ্গে খেতেও চাইছিলো না। সহপাঠী এবং বন্ধুরাও আমাকে আড় চোখে দেখছিলো। ”

এতোসব উপেক্ষা করে ফকিরাবাদ হাইস্কুল থেকে ১৯৯১ সালে এসএসসি এবং পুরান ঢাকার লক্ষীবাজার সোহরাওয়ার্দী কলেজ থেকে ১৯৯৩ সালে এসএইচসি পাশ করেন অনন্যা। বাবা মনোরঞ্জন এবং মা পারুল বালার আশ্রয় ছেড়ে ১৭ বছর বয়সে ভিন্ন সমাজে চলে আসেন।

স্বেচ্ছায় চলে এলেও সবসময় নিজের পরিচয় খুঁজে ফিরেছেন অনন্যা। বলেন, “একটা প্রশ্ন আমাকে কুরে কুরে খেয়েছে। কী আমার পরিচয়? এই প্রশ্ন এখনও মাঝেমধ্যেই তাড়া করে ফেরে আমাকে। ” বলতে বলতে গলা ধরে আসে তার।

অনন্যা জানান, ছোট বেলায় তার স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে মানুষের সেবা করবেন। কিন্তু হিজড়া হওয়ার কারণে তার সে স্বপ্ন ফিকে হয়ে যায়। তারপরও কারো কাছে হাত না পেতে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাকরি খোঁজেন। জুটেও যায়। ‘বন্ধু সোসাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’ নামে একটি এনজিওতে চাকরি শুরু করেন। অফিস কাকরাইলে। বাবা-মার বাড়ি পুরান ঢাকার শ্যামপুরে হলেও থাকতে শুরু করেন সাভারে। প্রতিদিন সাভার থেকেই আসা-যাওয়া করতে হয় তাকে।

মানবসেবার স্বপ্ন ভেস্তে গেলেও শৈশবে শেখা নাচ ধরে রাখতে ‘সত্ত্বা’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১২ জনের এই প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নাচও পরিবেশন করেছে।

অনন্যা রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। অভিযোগ করেন, তাদের কোনো সামাজিক স্বীকৃতি নেই। পারিবারিকভাবেও তারা উপেক্ষিত। কোনো আশ্রয় নেই। সে কারণেই তারা দলগতভাবে আশ্রয় খোঁজেন।  

এখন নিজের পায়ে দাঁড়ালেও অনন্যার মন সবসময় কাঁদে ছেড়ে আসা ভাই-বোনদের জন্য। মা-বাবা গত হয়েছেন অনেক আগে। চার ভাই ও পাঁচ বোনের কারোর সঙ্গেই তার আর যোগাযোগ নেই। কেউ খোঁজও রাখে না তার।
 
অনন্যা বলেন, “আমার জন্য অন্য বোনদের বিয়ে হবে না। এ কথা শুনে আর কখনো বাড়িতে যাইনি। ওরাও অন্যদের কাছে আমার পরিচয় দেয় না কখনো। ”

বাংলাদেশ সময়: ১৪২৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৫, ২০১৬
আরএটি/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।